দিনাজপুর সীমান্তে গত ৬ বছরে ৭২ জন বাংলাদেশিকে হত্যা করেছে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী-বিএসএফ।
গুলি এবং ধারালো অস্ত্র দিয়ে এ সব বাংলাদেশিকে নির্মম ও নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়েছে বলে রোববার দুপুরে দিনাজপুর প্রেসক্লাবে মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’ সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে এ তথ্য প্রকাশ করে।
তথ্যে বলা হয়, অধিকার-এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০০০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০১২ সালের ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত ১১ বছরে ৯শ ৪৪ জন বাংলাদেশিকে হত্যা করেছে বিএসএফ।
তাদের গুলিতে আহত হয়েছেন ১ হাজার ৫৫ জন এবং অপহরণের শিকার হয়েছেন ৯শ ৮১ জন বাংলাদেশি।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, বিএসএফের বিচারবহির্ভূত এ হত্যাকাণ্ড কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। তাছাড়া এ হত্যা আন্তর্জাতিক আইনকে লঙ্ঘন করেই চালানো হচ্ছে। নিহতদের অনেকেই গরিব কৃষক, যারা তাদের সীমান্ত সংলগ্ন তাদের নিজ ক্ষেতে কাজ করার সময় বিএসএফের হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন।
সংবাদ সম্মেলনে অধিকার-এর দিনাজপুর সমন্বয়কারী ও ডেইলি স্টারের দিনাজপুর প্রতিনিধি কংকন কর্মকার জানান, সীমান্তে হত্যার ব্যাপারে বিএসএফের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যে, এই সব বাংলাদেশি অবৈধভাবে ভারতীয় সীমান্তে ঢুকে গরু চুরি করতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়।
কিন্তু প্রশ্ন করা হয়, যেখানে সীমান্তে ভারতীয়রা বাংলাদেশিদের কাছে গরু বিক্রি করছেন এবং বাংলাদেশ সরকারও করিডোরের মাধ্যমে কর নিয়ে গরু নিয়ে আসার বিষয়টিকে বৈধতা দিয়েছে, সেখানে গরু চুরি করতে যাওয়ার প্রশ্নই আসে না। এখানেই দুই দেশের মধ্যে এক ধরনের সমন্বয়হীনতা রয়েছে, যা কুটনৈতিক উদ্যোগের মাধ্যমে সমাধান করা দরকার। তাহলে সীমান্তবাসীকে গরু চুরির মিথ্যা অভিযোগে গুলি অথবা বেয়নেটের খোঁচায় মরতে হবে না।
সংবাদ সম্মেলনে উল্লেখ করা হয়, সীমান্তের অধিবাসীদের আয়ের অন্যতম উৎস গৃহপালিত পশু। কিন্তু এই পশু বিক্রি করতে গিয়ে সীমান্তবাসী বিজিবি সদস্যদের দ্বারাও হয়রানির শিকার হচ্ছেন।
গত ৮ এপ্রিল বিজিবি ৪০ ব্যাটালিয়নের সদস্যরা বিরামপুর উপজেলার কাটলা সীমান্তে বসবাসকারী বিভিন্ন ব্লকে ২৬টি গরু আটক করেন।
এই সব গরু বাংলাদেশি হলেও বিজিবি সেগুলোকে ‘ভারতীয়’ হিসেবে আটক করার পর ৭টি গরু ফেরত দেয় এবং বাকি ১৯টি গরু এখনও ফেরত আসেনি। অথচ এইসব গরু বিক্রির জন্য ভাইগর ক্যাম্পের কোম্পানি কমান্ডারের সাটিফিকেটও ছিল।
সেই সার্টিফিকেট জব্দ করে বিজিবি ৪০ ব্যাটালিয়ন গরুগুলোকে নিজেদের জিম্মায় রাখায় সীমান্তবাসী হতভাগ্য গরুর মালিকরা অনিশ্চিয়তার মধ্যে রয়েছেন।
এদিকে, ৫ এপ্রিল বিএসএফ বাংলাদেশের ভাইগর সীমান্তে ঢুকে নিবিচারে বাংলাদেশিদের ওপর নির্যাতন চালায়। বিজিবি এই নির্যাতনের কথা স্বীকার করলেও বিএসএফের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি।
অপরদিকে, গত মার্চ মাসে বিজিবি জ্ঞাত-অজ্ঞাত নাম দিয়ে গ্রামবাসীর বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করে। মামলার পর থেকে বিভিন্ন এলাকার মানুষকে আটকে রেখে টাকার বিনিময়ে ছেড়ে দেয় বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
বিএসএফের সংঘটিত হত্যা, নির্যাতন এবং অন্যান্য মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো ‘অধিকার’ প্রতিনিয়ত পর্যবেক্ষণ করে আসছে।
অধিকারের পক্ষ থেকে এ সব ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে দোষী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানানো হয়।
সংবাদ সম্মেলনে সীমান্ত এলাকায় বসবাসকারী মানুষের প্রতি অন্যায়, অবিচার ও নির্যাতন প্রতিরোধের লক্ষে এবং গুলি বন্ধ করার দাবিতে ১৭টি দাবি উপস্থাপন করা হয়।
সরকারের প্রতি এইসব দাবির আলোকে সীমান্তে সব ধরনের নির্যাতন বন্ধ করার জন্য উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করার অনুরোধ জানানো হয়।
পাশাপাশি সীমান্তবাসীর অর্থকষ্ট দূর করাসহ জীবন-জীবিকার মান উন্নয়নের জন্য সরকারকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করার দাবিও জানানো হয়।
সংবাদ সম্মেলনে ‘অধিকার’-এর কর্মী মোস্তফিজুর রহমান মিলন, আজহারুল আজাদ জুয়েল, এসএম আলমগীর, মো. শাহজাহান, লাভলী আজাদ লিজা, রুবা জান্নাতুন, জিয়াউল হক প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া সীমান্তে নির্যাতনের শিকার বেশ কয়েকজন এবং তাদের পরিবারের সদস্যরা এই সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন।