ঠাকুরগাঁওয়ে মান্নান হত্যা : এখনও ধরা পড়েনি পরিকল্পনাকারী শান্ত

ঠাকুরগাঁওয়ে মান্নান হত্যা : এখনও ধরা পড়েনি পরিকল্পনাকারী শান্ত

ঠাকুরগাঁওয়ে সহকর্মীদের ছুরিকাঘাতে উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের অর্থ বিষয়ক সম্পাদক আব্দুল মান্নানের নৃংশসভাবে খুনের ঘটনায় শহরের আলোচনার ঝড় সৃষ্টি হয়েছে। পুলিশ খুনের সঙ্গে সরাসরি জড়িত সন্দেহে উপজেলা যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সজিব দত্তকে ইতোমধ্যে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছেন। কিন্তু মান্নান খুনের মূল পরিকল্পনাকারী মারুফ আলী শান্তকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গ্রেফতার করতে না পারায় জনমতে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।

এদিকে স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা মান্নান খুনের ঘটনায় জেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক দেবাশীষ দত্ত সমীরকে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে আটক করা হয়েছে বলে আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন অংঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীদের মাঝে প্রশ্ন উঠেছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, উপজেলা স্বেচ্ছাসেবকলীগ নেতা আব্দুল মান্নান পৌর শহরের ১০নং ওয়ার্ডের যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মারুফ আলী শান্ত’র ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল। শান্তর মাধ্যমেই যুবলীগ নেতা সজিব দত্তের সঙ্গে মান্নানের সম্পর্ক গড়ে উঠে। শান্ত ও সজিব দত্তসহ কয়েকজন মিলে বছর দু’এক আগে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, অসহায় মানুষের জমি জবর দখল, কয়েকটি রুটে থ্রি হুইলারের টোল আদায়, মাদক ব্যবসারসহ বিভিন্ন অপকর্মের সিন্ডিকেট গড়ে তুলেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। সেই সিন্ডিকেটের সঙ্গে স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা আব্দুল মান্নানের জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে।

কে এই শান্ত

ঠাকুরগাঁও পৌরসভার ১০নং ওয়ার্ডের গোবিন্দনগড় বড় বাড়ির মহল্লার মরহুম মোবারক আলী মেম্বারের ছোট ছেলে মারুফ আলী শান্ত। বাবা মারা যাওয়ার পর কিছু বন্ধুর পাল্লায় পড়ে শান্ত মাদক সেবনের দিকে পা বাড়ায়। এক সময় ক্ষমতা বিস্তার লাভের আশায় অগচরে যুবলীগের কর্মী হয়ে যায়। দলীয় সাংগঠনিকভাবে তৎপর হওয়ার সুবাদে ওই ওয়ার্ড যুবলীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয় শান্তকে।

এরপর থেকেই শুরু হয় শান্ত’র আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ হওয়ার গল্প। দলীয় ক্ষমতা ব্যবহার করে আস্তে আস্তে সন্ত্রাসী কার্যক্রম বৃদ্ধি করতে থাকেন। এলাকায় কেউ জমি ক্রয় করতে চাইতে শান্তকে দিতে হয় মোটা অংকের চাঁদা, কোনো ব্যক্তি মুন্সিরহাট ও দুরামারি নামক এলাকায় বাড়ি নির্মাণ করতে গেলে আগেই মোটা অংকের টাকার জন্য হুমকী প্রদান করে তার বাহিনী।

উপজেলা যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সজিব দত্তকে ব্যবহার করে টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, জমি দখল, গাড়ি থেকে টোল আদায় ও মাদক ব্যবসা আরো সক্রিয় করে তোলেন। কিছুদিন যাবত সেই সকল অপকর্মের টাকা নিয়ে বন্ধু আব্দুল মান্নানের সঙ্গে বিরোধ সৃষ্টি হয়। এক সসময় পথের কাটা হয়ে দাঁড়ায় আব্দুল মান্নান।

হত্যাকাণ্ডের অভিযুক্ত সজিব দত্ত

উপজেলা যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সজিব দত্ত ঠাকুরগাঁও শহরের আশ্রমপাড়া এলাকার গোরাঙ্গ দত্তের ছেলে। পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা ঠাকুরগাঁও শহরের প্রভাবশালী ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত। দেশ স্বাধীনের আগ থেকেই আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক অঙ্গনে পরিবারের সদস্যদের সুনাম ও খ্যাতি রয়েছে।

বেশ কয়েক বছর ধরে কিছু খারাপ বন্ধুর সঙ্গে মেলামেশায় মাদকাসক্ত হয়ে পড়েন সজিব দত্ত। বিষয়টি পারিবারিক ভাবে সবাই জেনে যায়। ভাল পথে ফেরার জন্য অনেকবার শাসনও করেন বড় ভাই পিন্টু দত্ত ও সমীর দত্ত। সাম্প্রতিককালে পারিবারিকভাবে তাকে শাসন করতে গিয়ে সজীব দত্ত বড়ভাই পিন্টু দত্ত ও সমীর দত্তকে ছুরিকাঘাত করেছিল বলে অসুস্থ বাবা গোরাঙ্গ দত্ত স্বীকারও করেছেন। তার কিছুদিন পর সজিব দত্ত মাদকাসক্ত হয়ে খুব কাছের বন্ধু রাজুকে মন্দিরপাড়ায় ছুরিকাঘাত করে। পরে পরিবার থেকে তাকে বের করে দেয় তার বাবা ও ভাই।

সেসময়ই শান্ত’র সিন্ডিকেটের মাধ্যমে নানা রকম অপকর্মের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে সজিব। শুরু করে ছিনতাই, চাঁদাবাজি, জমি দখল ও মাদক ব্যবসা।

সম্প্রতি সজিব দত্তের ভাই দেবাশীষ দত্ত সমীর ঠাকুরগাঁও জেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক ও জেলা পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়। এরপর ভাইয়ের নাম ভাঙিয়ে সজিব তার অপকর্মের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। একাধিক ভুক্তভোগী মানুষ সজিব দত্তের অপকর্মের কথা বড়ভাই দেবাশীষ দত্ত সমীরকে ও চাচাতো ভাই উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অরুনাংশু দত্ত টিটোকে অভিযোগ করলে সজিবকে সর্তক করে দেয় তারা।

কিছুদিন ধরেই সিন্ডিকেটের টাকা ভাগাভাগি নিয়ে সবিজ দত্ত, শান্ত ও আব্দুল মান্নানের সঙ্গে বিরোধ সৃষ্টি হয়। এর মধ্যেই মান্নানের সঙ্গে সজিব দত্তের কথা কাটাকাটি হয়।

কয়েকদিন আগে সিগারেট খাওয়াকে কেন্দ্র করে তাদের মধ্যে হাতাহাতি হয়। এসময় সজীব দত্ত মান্নানকে পরে দেখে নেয়ার হুমকি দিয়ে ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন। পরবর্তীতে আব্দুল মান্নান সজীব দত্তের বড় ভাই জেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক দেবাশীষ দত্তকে বিষয়টি অবহিত করলেও তা সুরাহা করেনি।

ওই ঘটনার জের ধরে যুবলীগ নেতা সজীব দত্ত ও শান্তসহ ৪ জন ১১ই জুলাই দিবাগত রাত সাড়ে ১২টায় আব্দুল মান্নানকে শহরের মুন্সিরহাট বিহারীপাড়া এলাকার গলিতে দেখে পেছন থেকে ধারাল অস্ত্র দিয়ে আঘাত করেন।

একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে ওই রাতে যুবলীগ নেতা সজিব মুন্সিরহাট বিহারি পাড়া এলাকায় শান্ত’র বাড়িতে সমাঝোতার জন্য আব্দুল মান্নানকে ডেকে পাঠায়। এর আগেই শান্ত’র নিজ বাড়িতে শান্ত ও সজিবসহ আরো দুইজন মান্নানকে মেরে ফেলার পরিকল্পনা তৈরি করে।

রাত ১১টায় আব্দুল মান্নান যুবলীগ নেতা শান্ত’র বাড়িতে গেলে সমাঝোতার এক পর্যায়ে আবারো কথাকাটি হয়। তখন মান্নান তাদের পরিকল্পনা বুঝতে পেরে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে বন্ধু জুম্মনকে কল দেয়। কিছুক্ষণ পর সজিব, শান্তসহ অজ্ঞাত আরো দু’জন আব্দুল মান্নানকে বিহারী পাড়ার গলিতে পথরোধ করে ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করতে শুরু করে। এর মধ্যেই ঘটনাস্থলে জুম্মন পৌঁছে প্রতিবাদ করার চেষ্টা করলে সজিব দত্ত উত্তেজিত হয়ে মোটরসাইকেলের উপরেই জুম্মনের পায়ে ধারালো অস্ত্র ঢুকিয়ে দেয়। পরে শান্ত লোহার রড দিয়ে জুম্মনের মাথায় আঘাত করলে সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। সেসময় মান্নান রক্তাক্ত অবস্থায় দৌড়ে পালিয়ে যায়। ঘটনাস্থলে শান্ত ও সজিবের ভয়ে স্থানীয় লোকজন নিরবতা পালন করেছেন বলে অনেকে জানিয়েছেন।

পরে সজিব দত্ত ও শান্ত জুম্মনকে পাশের একটি গোরস্থানে টেনে হেঁচড়ে নিয়ে গিয়ে রেখে মোটরসাইকেলযোগে পালিয়ে যায়।

এসময় স্থানীয় লোকজন আব্দুল মান্নান ও জুম্মনকে উদ্ধার করে ঠাকুরগাঁও আধুনিক সদর হাসপাতালে আনার পথে মান্নান অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণে মারা যান। আর জুম্মনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

পুলিশ হত্যাকান্ডের ঘটনায় জড়িত সন্দেহে যুবলীগ নেতা সজিব দত্তের বড় ভাই পিন্টু দত্ত ও মারুফ আলীর শান্ত’র বড়ভাই রতনকে আটক করে।

এদিকে খুনের ঘটনায় সেচ্ছাসেবকলীগ নেতা আব্দুল মান্নানের বড় ভাই আবু আলী হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত অভিযোগে যুবলীগ নেতা সজিব দত্ত ও মারুফ আলী শান্তসহ অজ্ঞাত ৩/৪জনকে আসামি করে ঠাকুরগাঁও থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।

পুলিশ ৫ দিন পর তথ্য প্রযুক্তির মাধ্যমে খুনের মুলহোতা যুবলীগ নেতা সজিব দত্তকে নওঁগা জেলা শহর থেকে আটক করে। একইদিন সজিব দত্তের ভাই জেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক দেবাশীষ দত্ত সমীরকে ঢাকা থেকে আটক করেন পুলিশ।

১৮ জুলাই পুলিশ আটকদের চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট আদালতে সোপর্দ করলে আদালতের বিচারক মোল্লা সাইফুল আসামিদের জেল হাজতে প্রেরণ করারর নির্দেশ দেন।

মামলার বাদী আবু আলী জানান, আমার ভাইয়ের খুনি সজিব দত্ত ও শান্ত’র সর্বোচ্চ শাস্তি চাই। পুলিশ এখন পর্যন্ত শান্তকে আটক করতে পারছে না কেন? শান্তকে আটক করলেই মূল ঘটনা বের হয়ে আসবে । হত্যাকাণ্ডে নির্দোষ ব্যক্তিদের মামলায় না জড়ানোর জন্য পুলিশ বাহিনীকে অনুরোধ করছি।

খুনের সাথে জড়িত অভিযুক্ত আসামি সজিব দত্তের চাচাতো ভাই উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অরুনাংশু দত্ত টিটো জানান, ঠাকুরগাঁওবাসীর মতো আমিও চাই সহকর্মী সেচ্ছাসেবকলীগের নেতা মান্নান হত্যার সুষ্ঠু বিচার। চাই হত্যাকারীদের সর্বোচ্চ সাজা।

ঠাকুরগাঁও পুলিশ সুপার ফারহাত আহমেদের কাছে জানতে চাইলে তিনি জানান, খুনের সাথে সরাসরি অভিযুক্ত সজিব দত্তকে আটক করে জেল হাজতে প্রেরন করেছেন আদালত। খুনের ঘটনায় অন্যতম আরেক আসামি শান্তকে ধরার জন্য পুলিশ চিরুনী অভিযান চালাচ্ছে। খুনের ঘটনায় সন্দেহভাজন আটকদের সম্পৃক্ততা না পেলে তাদের মামলায় জড়ানো হবে না।

জেলা সংবাদ