জেলা সদরের আলীনগর ইউনিয়নে ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ প্রকল্পের মাধ্যমে বদলে গেছে জোছনা বেগম (৩৫) এর ভাগ্য। এক সময় অসুস্থ স্বামী ও স্কুলপড়ুয়া ২ কন্যা নিয়ে প্রচন্ড অর্থকষ্টে থাকলেও তিনি এখন স্বাবলম্বী। ২০১৪ সালে একটি বাড়ি একটি খামারের ‘মধ্যে সাচিয়া গ্রাম উন্নয়ন’ দলের সদস্য হওয়ার পর থেকে ঘুরতে থাকে তার ভাগ্যের চাকা। এই সমিতির মাধ্যমে ইতোমধ্যে ঋণ নিয়েছেন অর্ধ লাখ টাকা। সেই টাকায় ছাগল, হাঁস, মুরগি, মাছ ও সবজি চাষ করে এখন স্বাবলম্বী জোছনা বেগম। ফিরে পেয়েছেন হারানো স্বচ্ছলতা।
বাসস’র সাথে আলাপকালে জোছনা বেগম জানান, তার স্বামি নাছির মাতাব্বর (৪০) দিনমজুরের কাজ করত। ২০১৩ সালের শেষের দিকে অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। ২ সন্তান নিয়ে চোখে, মুখে অন্ধকার দেখেন জোছনা। তিনি বলেন, নিদারুন অর্থকষ্টে চরম অভাবের মধ্যে দিন কাটাতে হয় তাদের। মেয়েদের স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। ২০১৪ সালে একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের কর্মকর্তারা তাদের বাড়িতে সদস্য সংগ্রহের জন্য উঠান বৈঠক করে।
ধারনা দেওয়া দেওয়া ‘একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প’ সম্পর্কে। তুলে ধরা হয় এর বিভিন্ন সুফল। জোছনাসহ কয়েকজন প্রতিবেশি মিলে মোট ৬০ জনের দল গঠন করা হয়। এর মাধ্যমে চলে গ্রাম উন্নয়নের পালা। বর্তমানে সাচিয়া গ্রামে অনেক নারীই গরু, ছাগল, হাঁস-মুরগি, মাছ, সবজি ইত্যাদি পালন ও চাষের মাধ্যমে স্বাবলম্বী হয়েছেন। সরকারের বিশেষ এই উদ্যেগে দারিদ্র্যতাকে জয় করছেন তারা।
জোছনা আরো জানান, প্রথমে ১০ হাজার টাকার ঋণ নেই সমিতি থেকে। সে টাকায় ২টি ছাগল কিনেন তিনি। ১ বছরে ২টি ছাগল মোট ৮টি বাচ্চার জন্ম দেয়। পরের বছর ছাগল বিক্রি করেন ১৫ হাজার টাকা ও ঋণ নেন ১৫ হাজার টাকা। এই টাকায় বাড়ির পাশের একটি পুকুর ও কিছু জমি লীজ নিয়ে মাছ ও সবজি চাষ শুরু করেন। চলতি বছর ঋণ নেন আরো ২৫ হাজার টাকা। পাশাপাশি আগে থেকেই হাঁস-মুরগি পালন করে আসছেন তিনি।
সরেজমিনে আলীনগরের মধ্যে সাচিয়া গ্রামে জোছনা বেগমের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় ছাগল পরিচর্যায় ব্যস্ত রয়েছেন। বর্তমানে ছোট-বড় মিলিয়ে ৮টি ছাগল রয়েছে। ২৪ শতাংশ জমির উপর লীজ নেওয়া পুকুরে তেলাপিয়া, রুই, কাতলসহ বিভিন্ন মাছের মিশ্র চাষ করা হচ্ছে। এছাড়া ২০ শতাংশ জমিতে লাউ, পেঁপে, কলা, মুগ ডাল চাষ করছেন। আর ১৪টি হাঁস ও ২০টি দেশি জাতের মুরগি রয়েছে। এখানে প্রচুর বিলাঞ্চল থাকায় হাঁস-মুরগির জন্য খুব একটা খাবার দিতে হয়না। তার বাড়িটি যেন একটি ক্ষুদ্র খামার।
জোছনা বেগমের বড় মেয়ে নাজনিন বেগম এবার স্থানীয় স্কুল থেকে এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। সে জানায়, তাদের হাঁস ও মুরগি মিলিয়ে দৈনিক প্রায় ১৫টি ডিম দেয়। আর বাজারে দেশি ডিমের ব্যাপক চাহিদা থাকায় প্রতিটি ডিম ১০/১১ টাকা দরে বিক্রি হয়। সে হিসাবে মাসে শুধু ডিম থেকই প্রায় ৫ হাজার টাকার কাছাকাছি লাভ হয়। এছাড়া গত মাসে লাউ, কলা ও পেঁপে বিক্রি করেছেন ৪ হাজার টাকার।
কথা হয় জোছনা বেগমের স্বামী নাছির মাতাব্বরের সাথে। তিনি জানান, ভারী কাজ করতে গিয়ে বুকে আঘাতপ্রাপ্ত হন তিনি। সেই থেকেই বেকার অবস্থার মধ্যে রয়েছেন। কিন্তু সরকারের ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ প্রকল্প তাদের অস্বচ্ছলতা দূর করেছে। তার স্ত্রীর নিরলস পরিশ্রমে তারা এখন ভালো আছেন। মেয়েরা আবার লেখা-পড়া শুরু করেছে। এ জন্য সরকারকে ধন্যবাদ জানান তিনি।
শুধু জোছনা বেগম নন, সালমা বেগম, সামসুন্নাহার, ইয়ানুর বেগম, রানু বিবি, নাজমা বেগমসহ অনেকেই ভাগ্য বদল করেছেন এ প্রকল্পের মাধ্যমে। তারা জানান, গ্রাম উন্নয়ন দলের মাধ্যমে নিয়মিত উঠোন বৈঠক ও কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ করা হয়। বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে আলোচনা ও কার্যকরি স্বিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।
সদর উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান আলহাজ্ব মো. ইউনুছ বাসস’কে জানান, একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সপ্ন-প্রসূত বৃহৎ একটি সামাজিক কর্মসূচি। এর মাধ্যমে পল্লী অঞ্চলের প্রতিটি বাড়ি অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে গড়ে উঠছে। বিশেষ করে নারীরা তাদের বিভিন্ন উদ্যেগের মাধ্যমে বাড়তি আয়ের সুযোগ পাচ্ছেন পরিবারে।
প্রকল্পের সদর উপজেলা সমন্বয়কারী লোকমান হোসেন বৃহস্পতিবার বাসস’কে বলেন, সদরের ১৩টি ইউনিয়নে ১১৭টি ওয়ার্ডে মোট ১৪৭টি সমিতি চালু রয়েছে। আর মোট সদস্য রয়েছে ৭ হাজার ৯২০জন। এর মধ্যে পুরুষ ৪ হাজার ৪শ’ ৯৩ ও নারী ৩ হাজার ৪শ’ ২৭জন রয়েছেন। এই প্রকল্প কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি ও জীবিকায়ন নিশ্চিতকরনের মাধ্যমে লাগসই এবং স্থায়ী দারিদ্র্য বিমোচনে ব্যাপক ভূমিকা রাখছে।
তিনি বলেন, বিশেষ করে নারীদের ভাগ্য উন্নয়নে এই প্রকল্প কাজ দিচ্ছে। একই সাথে সমৃদ্ধ করছে গ্রামীণ অর্থনীতিকে।