স্ত্রীর মৃত্যুর মামলায় ৬ বছর লড়ে জিতলেন স্বামী

স্ত্রীর মৃত্যুর মামলায় ৬ বছর লড়ে জিতলেন স্বামী

ভারতে চিকিৎসায় গাফিলতিতে স্ত্রীর মৃত্যুর অভিযোগে দায়ের করা এক মামলায় ছয় বছর ধরে আইনি লড়াই চালিয়েছেন এক স্বামী। কলকাতার অ্যাপোলো হাসপাতাল ও দুই চিকিৎসকের বিরুদ্ধে তিনি এ মামলায় লড়েন। মামলাটি কলকাতা থেকে দিল্লি পর্যন্ত গড়ায়। স্বামী নিজেই ছিলেন এ মামলার আইনজীবী। অন্য কোনো আইনজীবী তিনি নিয়োগ দেননি। ছয় বছর পর অবশেষে তার জয় হয়। ওই স্বামীর নাম শুভ্রশঙ্কর মুখোপাধ্যায়।

এ মামলায় দিল্লির আদালত অভিযুক্ত এক চিকিৎসককে ১২ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেয়ার নির্দেশ দিয়েছে। অার অ্যাপোলো হাসপাতালটিকে দিতে হবে ৪ লাখ টাকা। অন্য চিকিৎসক আপাতত জামিন দেয়া হয়েছে।

ছয় বছরের এই ‘অসম’ লড়াই জিতে যাওয়ার পরে কান্নায় ভেঙে পড়েন স্বামী শুভ্রশঙ্কর । এ সময় তিনি বলেন, ‘মৃত্যুশয্যায় শুয়ে চিরকুটে কাঁপা হাতে আমার স্ত্রী শর্মিষ্ঠা লিখেছিল—ডাক্তাররা আমাকে দেখেনি। এখানে ফেলে গেছে। শর্মিষ্ঠার যন্ত্রণার কিছুটা উপশম হয়তো হলো।’ তবে অন্য এক চিকিৎসককে আদালত ছাড় দেয়ায় পুরোপুরি খুশি হতে পারছেন না শুভ্রশঙ্কর। বলেছেন, ‘আরও যুদ্ধ বাকি।’

শুভ্রশঙ্করবাবুর অভিযোগ, অ্যাপোলো হাসপাতালে ২০১০ সালের ২৩ মার্চ ল্যাপেরোস্কোপিক পদ্ধতিতে অস্ত্রোপচার করে শর্মিষ্ঠাদেবীর পিত্তাশয়ের পাথর বের করেন চিকিৎসক পূর্ণেন্দু রায়। ২৫ মার্চ শর্মিষ্ঠাদেবী ডিসচার্জ হয়ে বাড়িও চলে যান। কিন্তু কিছুদিন পরেই তলপেটে ফের ব্যথা শুরু হয়। ৯ দিন পর আবার অ্যাপোলো হাসপাতালে ভর্তি হন। এমআরসিপি করে ধরা পড়ে তার পিত্তনালীর (বাইল ডাক্ট) ভেতরে আরও পাথর রয়ে গেছে। ৭ এপ্রিল ‘ইআরসিপি’ প্রক্রিয়ায় সেই পাথর অস্ত্রোপচার করে বের করেন চিকিৎসক মহেশ গোয়েন্কা। তার পরেই শর্মিষ্ঠাদেবীর অবস্থার অবনতি হয়। তার প্যাংক্রিয়াটাইটিস ধরা পড়ে। এক মাস ভেন্টিলেশনে থাকার পর ৭ মে তার মৃত্যু হয়।

ফুলবাগান থানায় এফআইআর করেন স্বামী শুভ্রশঙ্কর। পরোয়ানা জারি হওয়ায় আগাম জামিন নেন পূর্ণেন্দু রায়। শুভ্রশঙ্কর অভিযোগের ভিত্তিতে দেশটির স্বাস্থ্য দফতর তদন্ত কমিটি তৈরি করে।

তদন্তকারীরা মহেশ গোয়েন্কাকে ছাড় দেন। দোষী সাব্যস্ত হন পূর্ণেন্দু রায়। স্বামী শুভ্রশঙ্কর জানান, স্বাস্থ্য দফতরের তদন্তকারীরা মত দিয়েছিলেন আগে পিত্তনালীর পাথর বের করে তারপর পিত্তাশয়ের পাথর বের করা উচিত ছিল। সেটা চিকিৎসক পূর্ণেন্দু করেননি। পরীক্ষানিরীক্ষা করেননি বলে তিনি পিত্তথলির পাথরের কথা বুঝতেই পারেননি। এই পদ্ধতিগত ত্রুটির জন্য রোগিণীর শারীরিক জটিলতা বেড়েছিল।

এরপর কলকাতা জেলা ইউনিট-২ ক্রেতা সুরক্ষা আদালতে শুভ্রশঙ্কর চিকিৎসক পূর্ণেন্দু রায় ও ওই হাসপাতালের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেন।

২০১৪ সালে কলকাতা জেলা কমিশন পূর্ণেন্দু ও হাসপাতালের ক্ষতিপূরণ ধার্য করলেও রাজ্য কমিশন ২০১৫ সালে তা বাতিল করে দেয়। তখন শুভ্রশঙ্কর জাতীয় কমিশনে যান। ২০১৬ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর জাতীয় কমিশন রায় দেয়, অহেতুক রাজ্য কমিশন অভিযোগকারীকে মানসিকভাবে হেনস্থা করছে। গত ২০ জানুয়ারি রাজ্য কমিশন পূর্ণেন্দু রায় এবং অ্যাপোলো হাসপাতালকে ক্ষতিপূরণ দেয়ার নির্দেশ দেয়।

শুভ্রশঙ্করবাবুর মন্তব্য, ‘মহেশ গোয়েন্কাও কিন্তু নির্দোষ নন। পিত্তনালীর পাথর বের করতে তিনি এমন অস্ত্রোপচার করলেন যে আমার স্ত্রীর প্যাংক্রিয়াটাইটিস হয়ে যায়! গোয়েন্কার বিরুদ্ধে আমি মেডিক্যাল কাউন্সিলে লড়াই করছি।’

এই ব্যাপারে পূর্ণেন্দুর দাবি, ‘পিত্তাশয়ের পাথরের অপারেশনের পর কোনো জটিলতা হয়নি। সমস্যা হয় পরে মহেশ গোয়েন্কা ইআরসিপি করে পিত্তনালী থেকে পাথর বের করার পরে। কিন্তু দোষ এসে পড়ে আমার ঘাড়ে।’ তার আরও কটাক্ষ, ‘অনেকে প্রভাব খাটিয়ে বেঁচে যাচ্ছেন।’

অন্য দিকে মহেশ গোয়েন্কার পাল্টা অভিযোগ, ‘পূর্ণেন্দুবাবু যখন দেখলেন পিত্তাশয়ে পাথর রয়েছে আর রোগীর জন্ডিস আছে তখনই তার এমআরসিপি করে দেখা উচিত ছিল পিত্তনালীর মধ্যে পাথর রয়েছে কি না। সেটা উনি করেননি।’ তার মতে, ‘এর ফলে চিকিৎসা প্রক্রিয়াটাই অসম্পূর্ণ থেকে যায়। তাতেই জটিলতা বেড়েছে। পিত্তনালীর মধ্যে পাথর বেশিদিন থেকে গেলে প্যাংক্রিয়াটাইটিস হতে পারে। সেটাই হয়েছে।’

হাসপাতালের তরফে আইনজীবী প্রবীর বসু বলেন, ‘হাসপাতাল দোষী নয়, কিন্তু ঘটনাটা যেহেতু এখানে ঘটেছে তাই হাসপাতালকে কিছু ক্ষতিপূরণ দিতে বলা হয়েছে।’

আন্তর্জাতিক