দলীয় নেতাকর্মীদের সাথে গত ঈদের দিন ঈদ শুভেচ্ছা বিনিময়কালে বিরোধীদলীয় নেত্রী বলেন, সরকারের লুটপাটের কারণে, দ্রব্যমূল্যের উধর্্বগতি, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির জন্য দেশের মানুষ ভাল নেই। দেশের মানুষ আন্দেলন করছে দেশ ও গণতন্ত্রকে রক্ষার জন্য। বিএনপি আন্দোল করছে ব্যর্থ সরকারকে হটিয়ে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য। জালেম সরকারের জুলুম হতে দেশকে রক্ষার জন্য। সৌদি আরব হতে দেশে ফিরে ঈদের দিন নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে তিনি এ ঘোষণা দেন। দলের বিভিন্ন স্তরের নেতারা অবশ্য প্রতিদিনই নানাবিধ হুংকার, গর্জনের মাধ্যমে দলের মানুষদের উত্তেজিত করার অবিরাম চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। দামী পোশাক ও প্রসাধনে সজ্জিত হয়ে বিরোধীদলীয় নেত্রী যেভাবে হুংকার দিচ্ছিলেন মনে হচ্ছে ২০০১-২০০৬ পর্যন্ত তারা দেশকে স্বর্গরাজ্যে রেখেছিলেন। তিনি আরো বলেছেন, সাবেক প্রধান বিচারপতি এ.বি.এম খায়রুল হক টাকার বিনিময়ে বিভিন্ন রায় প্রদান করেছেন। একজন সুস্থ্য মস্তিষ্কের মানুষের পক্ষে এহেন বক্তব্য কল্পনা করা যায় না। সততা ও বলিষ্ঠতার মূর্ত প্রতীক মাননীয় কৃষিমন্ত্রী বিরোধী দলীয় নেত্রীর বক্তব্যের যথার্থ জবাবই দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, বিচারপতির গায়ে কালি লাগানোর চেষ্টার আগে নিজের দিকে তাকানো উচিৎ। যার গায়ে দুর্নীতির তকমা, তার একজন বিচারপতির গায়ে কাঁদা ছিটানোর চেষ্টা সুস্থ্য মানসিকতার পরিচয় বহন করেনা। পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের মাধ্যমে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল ও সামরিক শাসন জারির সুযোগ চিরতরে বন্ধ হওয়ায় খালেদা জিয়ার গাত্রদাহ ও মর্মবেদনা শুরু হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে খালেদা জিয়া জরিমানা দিয়ে কালো টাকা সাদা করে দুর্নীতিবাজ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন। তাঁর ছেলে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল কোর্টে দুর্নীতির দায়ে সাজা পেয়েছেন। তাদের ইতিহাস দুর্নীতির ইতিহাস। ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম অবাক বিস্ময়ে উচ্চারণ করেছেন, তাঁর বক্তব্য সভ্যতা, ভব্যতা, রাজনৈতিক সংস্কৃতির অবমাননা। সেই সঙ্গে মন্তব্যকারী তার নিজের পদ মর্যাদারও অবমাননা করেছেন। এহেন বক্তব্যে এদেশের মানুষ হতবাক হয়েছে এবং আদালত অবমাননার দায়ে অভিযুক্ত করেছে। প্রবীন পার্লামেন্টারিয়ান সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত যথার্থই বলেছেন, এহেন বক্তব্যের জন্য খালেদা জিয়াকে জাতির কাছে নিঃশর্ত ক্ষমা চাইতে হবে। নইলে আদালত অবমাননার দায়ে অভিযুক্ত হতে পারেন। তাঁর বক্তব্য উগ্র, অশোভন ও অশ্লীল।
২০০১-২০০৬ সময়কার ভয়াবহ চিত্র মনে হলে এদেশের মানুষ এখনো শিউরে উঠে। জুলুম ও জালেমের শাসন ছিল বিএনপি জামাতের সেই শাসনকাল। তখন সালসা নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে তারা কি করেছেন একবার তা স্মরণ করার জন্য সবিনয় অনুরোধ জানাচ্ছি। পক্ষান্তরে ২০০৮ এর নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে মহাজোট এর সরকার কি করছেন তুলনা করার জন্য বিএনপি নেতাদের আবেদন জানাচ্ছি। মহাজোট সরকার বিজয়ের পর বিএনপি জামাতের কোন মানুষকে এলাকা ছাড়তে হয়নি। কোন অত্যাচারের সম্মুখীন হতে হয়নি। আর ২০০১ এর পর ক্ষমতায় এসেই বিএনপি জামাত যে অত্যাচার, অবিচার, হত্যা, সন্ত্রাস, ধর্ষন ও অরাজকতা চালিয়েছে উহা অবর্ননীয়। টেলিভিশনে ‘ফিরে দেখা’ অনুষ্ঠানে তখনকার বাস্তব চিত্র নিত্য দিন প্রকাশিত হচ্ছে। তখনকার পত্র পত্রিকার পাতা উল্টালেও দেখা যাবে ভয়াবহ চিত্র। বিএনপি জামাত চারদলীয় জোটের মানুষদের ঐ সময়কার কর্মকান্ড একবার উপলব্ধি করার অনুরোধ জানাচ্ছি। সমাজের সর্বস্তরে যে হত্যা, সন্ত্রাস ও ধ্বংস তারা সংঘটিত করেছেন তা আইয়ামে জাহেলিয়াতকেও হার মানাবে। সকলের বিবেককে জাগ্রত করার অনুরোধ জানাচ্ছি।
ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময়ে এহেন বক্তব্য ঈদের আমেজের সাথে যথার্থ কিনা তাই সাধারণ মানুষের প্রশ্ন। অবশ্য সেখানে সাধারণ স্তরের মানুষ যেতে পেরেছিলেন কিনা সমাগম দেখে বুঝা যাচ্ছে না। দুর্নীতিতে যারা আকণ্ঠ নিমজ্জিত তাদের কাছ হতে এহেন বক্তব্য ছাড়া অন্য কিছু আশা করাও দূরাশা। বিচারপতি এ.বি.এম. খায়রুল হক একজন সৎ, নিষ্ঠাবন, আদর্শবান, বিজ্ঞ ও আপদমস্তক খাঁটি ভদ্রলোক। এহেন বিচারপতি সম্পর্কে এমন কটুক্তি একজন শ্রেষ্ঠ ইবলিসের পক্ষেও সম্ভব নয়। আমি বিভিন্ন সেমিনার, আলোচনা অনুষ্ঠানে তার জ্ঞানগর্ভ বক্তব্য শুনেছি। তিনি প্রকৃতই একজন জ্ঞানবান মানুষ। তার আচার আচরণে কথা বার্তায় শ্রদ্ধা আসে। তিনি যে সব যুগান্তকারী রায় প্রদান করেছেন, এসব রায়ে কট্টর জামাত-বিএনপির আইনজীবীরাও বিরূপ কিছু বলতে পারবেন বলে মনে হয় না। এইসব যুগান্তাকারী রায় সমূহ পৃথিবীর ইতিহাসে আগামীকালে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবে জ্বল জ্বল করে জ্বলবে। বিচার বিভাগের ইতিহাসে মহান বিচারপতি এ.বি.এম. খায়রুল হকের নাম উজ্জ্বল জোতিস্কের মতো অমর হয়ে থাকবে আবহমানকাল। একজন সৎ মানুষ সম্পর্কে এহেন নোংরা কটুক্তি, নোংরা মুখ দিয়েই বের হওয়া সম্ভব। কোন ভদ্রলোক এহেন বক্তব্যের নিন্দা না করে পারেন না। আমি এই উক্তিকারীকে আমার ঘৃণা ও ধিক্কার জানাই। আমি প্রার্থনা করব মাননীয় বিচারপতি এ.বি.এম. খায়রুল হক যে সব রায় দিয়েছেন, আগামী দিনের বিচারপতিগন তাকে অনুসরণ করে সত্য ও ন্যায়ের ঝান্ডাকে সমুজ্জ্বল রাখবেন। কোন অর্বাচীন, কোন অসৎ আত্মা কি বলল বা কটুক্তি করল তাতে কিছু যায় আসেনা। মহাকালের ইতিহাসে খায়রুল হকরা নন্দিত হবেন, আর কটুক্তিকারীরা নিন্দিতই হবেন। ভদ্রলোকের এতে কিছুই যায় আসে না। মাননীয় বিচারপতি আপনি স্বমহিমায় চিরভাস্বর হয়ে থাকবেন। আর দুর্নীতিবাজরা একদিন নিজের বক্তব্যের জন্যই মুখ দেখাতে পারবেননা। বিরোধী দলীয় নেত্রীর এ অশোভন বক্তব্যের জন্য আমি লজ্জাবোধ করছি। চিকিৎসার জন্য জনাব এ.বি.এম. খায়রুল হকের মতো ইতোপূর্বে অনেক বিচারপতিও সরকার হতে আর্থিক সহায়তা নিয়েছেন। এতে দোষের বা বেআইনী কিছু নেই। তা হলে অন্যান্য বিচারপতিগণও কি টাকার বিনিময়ে রায় দিয়েছেন? এহেন জঘন্য বক্তব্য কখনো কাম্য হতে পারে না।
১৯৭১ সনে নয় মাস একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। ৭ মার্চ ১৯৭১ জাতির জনক ঘোষণা করেছিলেন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম্#৮৭২২;এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। আমরা রক্তের বদলে ছিনিয়ে এনেছি প্রিয় এই স্বাধীনতা। স্বাধীনতার তিন বছরের মাথায়ই জাতির জনককে সপরিবারে হত্যা করা হয়। যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশকে গড়ে তুলতে জনককে সে সময় ও সুযোগ দেওয়া হয়নি। দেশি-বিদেশি চক্রান্তে জনকের স্বপ্নকে অংকুরেই হত্যা করা হয়। অর্থনৈতিক মুক্তি ছাড়া স্বাধীনতা অর্থহীন। সে লক্ষ্য অর্জনে এখন এগুতে হবে। স্বাধীনতার ৪০ বছর পেরিয়ে গেছে। আমরা আজো তেমন উন্নয়ন সাধন করতে পারিনি। অর্থনৈতিক মুক্তি ছাড়া জনকল্যাণকামী সরকার প্রতিষ্ঠা হতে পারেনা। এই চিন্তা ও চেতনায় সকল মানুষের কাজ করে যেতে হবে। ৪০ বছরের ৩০ বছর এদেশ শাসন করেছে কায়েমী স্বার্থবাদী, সামরিক, স্বৈর ও লুটেরা শাসকেরা। প্রকৃত পক্ষে ৯০ এর পর একটি সুযোগ এসছিল। কিন্তু বেসামরিক আবরনে সামরিক ভাবধারাই শাসন করেছে দেশ। ১৯৯১-১৯৯৬ ও ২০০১-২০০৬ পর্যন্ত যে সরকার দেশ শাসন করেছে তাদের সামগ্রিক কর্মকান্ড পর্যালোচনা করলে, উহাই দেখা যায় যে এরা নিজেদের ভাগ্য উন্নয়নে বেশি মনোযোগী ছিল। সাধারণ মানুষের উন্নয়নের জন্য তেমন কিছুই করেনি। নিজের পরিবার ও দলীয় ক্যাডার বাহিনী অর্থবিত্তে স্ফীত হয়েছে। লুণ্ঠিত হয়েছে জনগণের সম্পদ। মৌলবাদ, জঙ্গীবাদ প্রসার পেয়েছে। একাত্তুরের পরাজিত শক্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। স্বাধীনতার স্বাদ সাধারণ মানুষ ভোগ করতে পারেনি। তাদের অধিকার, স্বপ্নসাধ ব্যর্থ হয়েছে। বর্তমানে বিভিন্ন খবরে, দেশি বিদেশি তথ্যে অনেক ভয়াবহ চিত্র প্রকাশিত হচ্ছে। বস্তুত: জাতির জনক হত্যার পর এক ভয়ংকর থাবা দেশের সুষ্ঠু গতিধারাকে স্তব্ধ করে দিয়েছ্#৮ে;৭২২;ক্ষত বিক্ষত করেছে। আশা করি সকল মহলের শুভ বুদ্ধির উদয় হবে। এই বিশ্বায়নের যুগে ‘একের অনলে বহুরে আহুতি দিয়া’ এই নীতিতে চলা ছাড়া উপায় নেই। আমাদের এই অঞ্চলের শ্লোগান হবে এসো মুসলিম, এসো হিন্দু, এসো বৌদ্ধ, এসো খ্রিস্টান, এসো জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকল ভাই ভাই এক সাথে এক প্রানে কাঁধে কাঁধে দাঁড়াই। এই ভারতের মহামানবের সাগর তীরে আমরা সবাই ভাই ভাই।
ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরের মধ্য দিয়ে এক নতুন যুগের সৃষ্টি হোক। উন্মোচিত হোক সম্ভাবনার এক নতুন দিগন্ত। মানুষের কল্যাণে, দেশের উন্নয়নে সামগ্রিক গতিধারায় দুই প্রতিবেশী দেশ কাজ করে যাবে স্ব স্ব দেশের স্বার্থ রক্ষা করে একটি সুখী সমৃদ্ধশালী দেশ গড়ার জন্য। সহযোগিতার হাত সমপ্রসারিত থাকবে একে অপরের প্রতি। আমরা কেউ কারো প্রভু নই্#৮৭২২;আমরা পরীক্ষিত সৎ বন্ধু হিসেবে কাজ করে যাব অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বিগত বছর ভারত ভ্রমণ করেছেন। উভয়ের সৎ প্রয়াস স্বার্থক হোক উভয় দেশের জনগণের উহাই প্রত্যাশা। এই সাথে উভয় দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল গুলোর, বিভিন্ন মত ও পথের মানুষদেরও হতে হবে উদার ও ভ্রাতৃত্বের সেতু বন্ধনে আবন্ধ। মানুষ মানুষের জন্য, একদেশ আরেক দেশের সহায়তার জন্য, ভ্রাতৃত্বের হাতকে সমপ্রসারিত করে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে এক শান্তিময় পৃথিবী গড়ার জন্য। পৃথিবী হতে বন্ধ হোক হিংসা, বিদ্বেষ, যুদ্ধ ও হত্যা। সকলের সম্মিলিত প্রয়াসে রচনা করতে চাই স্বর্গের এক পৃথিবী। পবিত্র রমজান, পবিত্র ঈদ, ক্রিস্টমাস, পুজা অর্চনা, সুচি শুভ্রতা, আরাধনা সকল ধর্মের মানুষকেই জাগ্রত করুক। সৃষ্টিকর্তার কৃপায় আমরা সবাই শুদ্ধ হই। মাটির পৃথিবীতে গড়ে তুলি স্বর্গের স্বাদ। আমাদের শুভবুদ্ধির উদয় হোক। আমরা নিজেদের ভুল শোধরিয়ে, অপকর্মের জন্য অনুতপ্ত হয়ে, নিজেদের নিয়োজিত করি মানুষের কল্যাণে, দেশের উন্নয়নে এবং একটি সুখী, সমৃদ্ধশালী ও আদর্শ রাষ্ট্র বিনির্মানে। রাজনীতিবিদগণ তাদের সততা, নিষ্ঠা, সেবা, দেশপ্রেম ও অধ্যবসায় দিয়ে গড়ে তুলবেন দেশটাকে। দুঃখী মানুষের মুখে ফুটাবেন অনাবিল হাসি উহাই প্রত্যাশা। আমরা ভুলে যেতে চাই সব ব্যর্থতা, গ্লানি কটুক্তি ও অসভ্যতা। ৭১ এর চেতনায় ফিরে পেতে চাই একটি সুখের আবাসভূমি। মানুষ মনের মাধুরী দিয়ে গাইবে, “আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি”।
(লেখক সাবেক সচিব)