ভারতে ৫শ ও ১ হাজার টাকার নোট বাতিলের ফলে প্রভাব পড়েছে সীমান্ত বাণিজ্যে। ভারত থেকে বাংলাদেশে আসা পণ্যবাহী ট্রাকের সংখ্যা প্রায় অর্ধেকে দাঁড়িয়েছে। ওপারের মুদ্রা বিনিময় দোকানগুলোও কার্যত বন্ধের আশঙ্কায়। সব মিলিয়ে লোকসানের মুখে দাঁড়িয়ে অনেক ব্যবসায়ী।
বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে এলসি ও টিটির সংখ্যা কমেছে অর্ধেকেরও বেশি। কবে নাগাদ এ মন্দা কাটতে পারে সে ব্যাপারে স্পষ্ট করে কেউ বলতে পারছে না।
কমেছে বাংলাদেশিদের ভারতে যাতায়াতও। বেনাপোলের বিপরীতে পেট্রাপোল চেকপোস্ট থেকে কলকাতাগামী বাস দাঁড়িয়ে আছে রাস্তার পাশে যাত্রীর অপেক্ষায়।
বেনাপোল বন্দর দিয়ে আমদানিকারক ঢাকার হাজারীবাগের রবিন এন্টারপ্রাইজের সত্ত্বাধিকারী রবিন জানান, এখন এলসি খুললে লাভতো দূরের কথা, অর্ধেক পুঁজিও থাকবে না। এছাড়া ভারতীয় রফতানিকারকরাও রুপির বাজার স্বাভাবিক হওয়ার পর এলসি খুলতে বলেছেন। তাই আপাতত আমদানি কার্যক্রম বন্ধ রেখেছেন তারা। দ্রুত এ সমস্যা কাটিয়ে উঠতে না পারলে উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা করছেন তিনি।
অপর রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান যশোরের অভয়নগর উপজেলার সিডলু টেক্সটাইল বিডি লিমিটেডের প্রতিনিধি আইয়ুব হোসেন জানান, চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে প্রতিদিন তাদের ৬ থেকে ৭ ট্রাক পণ্য ভারতে রফতানি হয়েছে। এখন রুপি বাতিল ও নতুন রুপি সংকটের কারণে ভারতীয় আমদানিকারকরা ব্যাংকে টিটি করতে পারছেন না। এতে নতুন করে রফতানি বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে।
জানা যায়, বাংলাদেশি কোনো আমদানিকারককে ভারত থেকে পণ্য আমদানির জন্য প্রথমে ভারতীয় রফতানিকারকের নামে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে পণ্যের বাজার মূল্যের সমপরিমাণ ইউএস ডলার দিয়ে এলসি খুলতে হয়। ভারতীয় রফতানিকারকরা নিজের অর্থে ওই পণ্য কিনে বাংলাদেশে পাঠান। বন্দর থেকে পণ্য খালাস করার পর রফতানিকারকরা ব্যাংক থেকে আমদানিকারকের পাঠানো এলসির টাকা তোলেন।
কিন্তু এখন ভারতীয় ব্যাংকে পর্যাপ্ত নতুন নোটের সরবারহ না থাকায় তারা এলসির পাওনা টাকা ওঠাতে পারছেন না। ফলে লোকসানের ভয়ে এলসিও করতে চাইছেন না ব্যবসায়ীরা। বাংলাদেশি পণ্য রফতানির ক্ষেত্রেও একই সমস্যা।
বেনাপোল ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড এর এলসি শাখার প্রধান কর্মকর্তা আরাফাত হোসেন জানান, অনেক আমদানিকারক তাকে ফোন করে জানিয়েছেন যে ভারতীয় রুপি বাতিলে বাংলাদেশি টাকার মান আগের চেয়ে কমে গেছে। এতে লোকসানের ভয়ে তারা আপাতত এলসি খুলছেন না।
ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী চলতি মাসের ১ থেকে ৬ তারিখ পর্যন্ত বেনাপোল শাখায় ১৩ জন আমদানিকারক এলসি খুলেছেন। আর রুপি বাতিলের পর ৭ থেকে ১৯ নভেম্বর পর্যান্ত মাত্র ১০টি এলসি খোলা হয়েছে।
ভারতের পেট্রাপোল বন্দরের রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান মেসার্স রায় ট্রেডার্সের মালিক প্রদীপ কুমার রায় জানান, ৫০০ ও হাজার রুপি বাতিলের ফলে ব্যাংকগুলোতে নোটের সরবারহ কম।
এজন্য পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার আগ পর্যন্ত কারেন্ট অ্যাকাউন্ট হোল্ডার ব্যবসায়ীরা সপ্তাহে সর্বোচ্চ ৫০ হাজার রুপি উঠাতে পারবেন। আর সেভিংস অ্যাকাউন্ট হোল্ডাররা ২৪ হাজার টাকা তুলতে পারবেন। কিন্তু এ পরিমাণ রুপি দিতেও হিমশিম খাচ্ছে ব্যাংকগুলো।
রুপি বাতিলের প্রভাব পড়েছে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যেও। পেট্রাপোল ক্লিয়ারিং এজেন্ট স্টাফ ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন সূত্রে জানা গেছে, সাম্প্রতিক সময়ে ভারত থেকে প্রতিদিন গড়ে ৪০০টি ট্রাক পণ্য নিয়ে বেনাপোল বন্দরে যাচ্ছিল ভারতীয় ট্রাক। কিন্তু ওই সংখ্যাটা কমে গিয়েছে।
সংগঠনের সম্পাদক কার্তিক চক্রবর্তী জানান, সব থেকে বেশি প্রভাব পড়েছে পচনশীল পণ্য রফতানির ক্ষেত্রে। আগে রোজ ১৫টি ট্রাক পান নিয়ে গেলে এখন যাচ্ছে মাত্র ৪টি। কারণ, মাছ বা পানের মতো পচনশীল পণ্য নগদ টাকায় লেনদেন হয়। পুরনো ৫০০-১০০০ টাকার নোট না চলায় ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
তাছাড়া, ট্রাক মালিকেরা নগদ টাকায় ট্রাক ভাড়া দেন পণ্য পরিবহণের জন্য। সেটাও বন্ধ হয়ে গিয়েছে। বন্দর এলাকায় সরকারি পার্কিংয়ে ৫শ-১ হাজার রুপির নোট না চলায় রফতানিকারীরা ট্রাক রাখতে সমস্যায় পড়েছেন। এভাবে চলতে থাকলে বাণিজ্যে প্রচুর ক্ষতি হবে বলে তাদের আশঙ্কা। যার সুদূর প্রভাব পড়বে দুদেশের সীমান্তের অর্থনৈতিক পরিকাঠামোতেও।
বেনাপোল চেকপোস্ট কাস্টমস কার্গো শাখার রাজস্ব কর্মকর্তা (সুপার) আব্দুস সামাদ জানান, ১ থেকে ২ নভেম্বর পর্যন্ত ২২৫ ট্রাক বাংলাদেশি পণ্য ভারতে রফতানি হয়। রুপি বাতিলের ঘোষণার পর ১৩ ও ১৪ নভেম্বর রফতানি হয় মাত্র দেড়শ ট্রাক। একইভাবে কমেছে আমদানিও।