যে যাই বলুক না কেন, আজ থেকে ১৬ বছর আগে টাইগাররা যখন টেস্ট খেতলতে শুরু করে তখন বাংলাদেশের ক্রিকেট ছিল একদিনের সীমিত ওভার কেন্দ্রিক। ঢাকা লিগ, দামাল স্মৃতি ক্রিকেট, বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস ও শহীদ স্মৃতি ক্রিকেট খেলে খেলেই হাত পাকিয়েছে আমিনুল, আকরাম, নাইমুর ও রফিকরা। টেস্ট মর্যাদা প্রাপ্তির পূর্বশর্ত হিসেবে আইসিসির দেওয়া প্রেসকিপশন অনুসরণ করে তিন দিনের জাতীয় লিগ শুরু ১৯৯৮-৯৯ সালে। মাত্র দুবছর নাম মাত্র তিন দিনের ম্যাচ খেলার অভিজ্ঞতা দিয়ে শুরু দুর্জয়দের টেস্ট যাত্রা। দেখতে দেখতে টেস্ট ক্রিকেটে ১৬ বছর কাটিয়ে ফেললো টিম বাংলাদেশ।
আজ মুশফিক, তামিম, মাহমুদউল্লাহরা যেভাবে নিজেকে টেস্ট খেলার টেস্ট খেলার জন্য তৈরি করছেন, তখন তা কিছুই ছিল না। ব্যাটিং, বোলিং, ফিল্ডিংয়ের জন্য স্পেশাল কোচ বহু দূরে ট্রেনার, ফিজিও ছিল না। কোচ সারওয়ার ইমরানের হাত ধরেই অল্প প্রস্তুতিতে টেস্ট যাত্রা শুরু, তাও আবার ভারতের মত প্রবোল পরক্রমশালী দলের বিরুদ্ধে। শেষ পরিণতি যাই হোক না কেন, শুরুটা কিন্তু মন্দ হয়নি। আমিনুল ইসলাম বুলবুলের ১৪৫ রানের সঙ্গে হাবিবুল বাশারের ৭১ রানের উপর ভর করে নিজেদের প্রথম ইনিংসে ৪০০ রান করে বাংলাদেশ।
একটি অপ্রস্তুত, অনভিজ্ঞ ও অপরিণত দলের কাছ থেকে টেস্ট যাত্রার প্রথম ইনিংসে ৪০০ রান যে বিশাল কিছু তা বলার অপেক্ষা রাখে না। যেহেতু দীর্ঘ পরিসরের ক্রিকেটে খেলার অভ্যাস কম ছিল, তাই পরের ইনিংসে সেই ধারাবাহিকতা ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। দ্বিতীয় ইনিংসে ৯১ রানে অল আউট হয়ে গিয়ে ৯ উইকেটের হার।
এখন যেমন চার দিনের এনসিএল, বিসিএল হচ্ছে, তখন মাত্র দু বছরের তিন দিনের ম্যাচ খেলার প্রস্তুতি নিয়ে কোন টেস্ট খেলোয়াড়ের অধীনে প্রশিক্ষণ ছাড়া, এর চেয়ে ভালো খেলা সম্ভব ছিল না। অপ্রস্তুত, অনভিজ্ঞ ও অপরিণত দলের টেস্ট যাত্রা যেমন হওয়ার কথা ১৬ বছর আগে ক্রীড়াকেন্দ্র বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে তেমনি হয়েছিল বাংলাদেশের। তারপর ধীরে ধীরে নিজেদের প্রস্তুত তৈরি করার চেষ্টা, পর্যায়ক্রমে এডি বারলো, ট্রেভর চ্যাপেল, মহসিন কামাল, হোয়াটমোর, স্টুয়ার্ট ল, জিমি সিডন্স ও হাথুরুসিংহের হাত ধরে আজকের টেস্ট ক্রিকেটের বাংলাদেশ।
তবে সমালোচকরা বলছেন প্রায় দেড় যুগে বাংলাদেশের টেস্ট ক্রিকেট যেখানে পৌঁছানোর কথা ছিল, সেখানে পৌঁছাতে পারে নি। ওয়ানডেতে দল হিসেবে দাঁড়িয়ে গেলেও টেস্টে এখনো মেরুদন্ড সোজা করে দাঁড়াতে লড়ছে বাংলাদেশ। অপ্রস্তুত অবস্থায় শুরুতে অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকার কঠিন কন্ডিশনে গিয়ে বেশি টেস্ট খেলতে গিয়ে খাবি খাওয়া আত্মবিশ্বাসে চির ধরেছিল। আর তা কাটিয়ে উঠতেই লেগেছে প্রায় দেড় যুগ।
এখন আবার দেশে বেশি খেলা আর বাইরে কম, সেটাও অনেক দিন পর পর। তারপরও আগের চেয়ে উন্নতির ছোঁয়া পরিষ্কার। শ্রীলঙ্কার মাটিতে মুশফিকের ২০০, আশরাফুলের ১৯০ রানের সুবাধে বাংলাদেশের লড়াকু ড্র টেস্টে আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনার টনিক। এরপর গত বছর খুলনায় পাকিস্তানের সঙ্গে তামিম-ইমরুলের রেকর্ড ৩১২ রানের জুটিতে ড্র। এছাড়া এর আগে কুমার সাঙ্গাকারার ত্রিপল সেঞ্চুরির ম্যাচে ৫৮৭ রানের পাহাড়ে চাপা না পরে শামসুর রহমানের ১০৬ আর ইমরুল কায়েসের ১১৫ রানের সুবাধে টেস্ট অমিমাংসিত রাখা, উন্নতির পরিষ্কার চিহ্ন।
আর এবার ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে হার এড়ানোর মানসিকতা থেকে বেরিয়ে এসে জয়ের দুর্নিবার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে মাঠে নামা। প্রথম থেকে টেস্ট সিরিজ জয়ের স্বপ্ন লালন ও সেই মত লক্ষ্য-পরিকল্পনা প্রণয়ন, কুক, রুট ও মঈন আলিদের বিরুদ্ধে টার্নিং উইকেটই যে হতে পারে সাফল্যের ক্ষেত্র। আর তা ভেবেই দুই বাঁহাতি সাকিব-তাইজুলের সঙ্গে মিরাজের অন্তর্ভুক্তি। ইংলিশ ব্যাটিংয়ের বড় অংশই বাঁহাতি। তাদের বিরুদ্ধে অপস্পিনার মিরাজ সফল হতে পারেন এমন দূরদর্শী চিন্তা হয়েছে সফল। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ১৪ ম্যাচ খেলার অভিজ্ঞতা নিয়ে মিরাজের বাজিমাত। তেড়েজুড়ে শট খেলা কমিয়ে তামিমের দায়িত্বশীল হয়ে ওঠা, সঙ্গে ইমরুল, মুশফিক, রিয়াদ, সাকিব ও সাব্বিরদের সময়উপযোগী ব্যাটিং আর স্পিন সহায়ক পিচে অভিজ্ঞ সাকিবের সঙ্গে আনকোরা তরুণ মিরাজের স্পিন, একই ফলশ্রুতিতে ঢাকায় ধরা দিয়েছে ইংলিশদের বিপক্ষে তিন দিনেই ১০৮ রানের অবিস্মরণীয় জয়।
এ জয়ের দেখা মিলতে পারতো চত্তগ্রামেও। চতুর্থ ইনিংসে ২৮৬ রানের কঠিন চ্যালেঞ্জের পিছু ধেয়েও সাফল্যের বন্দরের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিল বাংলাদেশ, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ২২ রানের হার। আর তা হতাশার বদলে শেরেবাংলায় শক্তি হয়ে দেখে দেয় পরের টেস্টেই। এই প্রথম টানা দুই টেস্টে জয়ের মত ক্রিকেট খেলে বাংলাদেশ। আগের মত এক টেস্টে ভালো খেলে পরের টেস্টে সব তালগোল পাকিয়ে যায়নি। ধারাবাহিকতা ছিল খেলাটা পাঁচদিনের। সে বোধও উপলব্ধি হয়েছে অনেক বেশি। সেশন অনুযায়ী খেলার মানসিকতা বেড়েছে অনেক। তাতেই উন্নতির সিঁড়ি বেয়ে উপরে ওঠা। দেরিয়ে হলেও ঘরের মাঠে টেস্টেও ভালো খেলতে শুরু করেছে বাংলাদেশ। এখন দেশের বাইরে গিয়ে অনভ্যস্ত কন্ডিশনে প্রতিকূলতাকে জয় করতে পারলেই বলা যাবে টেস্টেও ভালো দল হতে দশুরু করেছে বাংলাদেশ।