পর্যাপ্ত তথ্য ও নমুনা ছাড়া সঠিকভাবে ব্যাঙের প্রজাতি শনাক্ত করা কঠিন কাজ। কারণ অনেক সময় দেখা যায় একই প্রজাতির ব্যাঙ বিভিন্ন রঙের হয় আবার বিভিন্ন প্রজাতির ব্যাঙের রং প্রায় একই রকম। ব্যাঙ শনাক্তকরণের জন্য পর্যাপ্ত তথ্য ও নমুনা বাংলাদেশের কোথাও সংগৃহীত হয়নি। এ সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও দেশে নতুন ব্যাঙের নমুনা তালিকাভুক্ত হওয়া থেমে নেই।
সম্প্রতি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও বাঘ বিশেষজ্ঞ ড. মনিরুল হাসান খান নতুন প্রজাতির দুটি ব্যাঙের সন্ধান পেয়েছেন। পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙামাটি ও বান্দরবন জেলা থেকে সন্ধানকৃত নতুন প্রজাতির এ দুটি ব্যাঙের ইংরেজি নাম যথাক্রমে Anderson`s Bush Frog এবং Nicobarese Frog । এর আগে বাংলাদেশে এই দুই প্রজাতির ব্যাঙের সন্ধান পাওয়া যায়নি বলে জানান ড. মনিরুল হাসান খান।
রাঙামাটি জেলার কাপ্তাই জাতীয় উদ্যানে সন্ধানকৃত ব্যাঙের নাম Anderson`s Bush Frog । এর বৈজ্ঞানিক নাম Philautus andersonis.
ব্যাঙের বৈশিষ্ট হিসেবে ড. মনিরুল হাসান খান বলেন, ‘এই ব্যাঙের নাকের ডগা থেকে পায়ু পর্যন্ত দৈর্ঘ্য ২৪-২৫ মিলিমিটার। ব্যাঙটি দেখতে উপরের দিক বাদামি থেকে জলপাইরাঙা আর নিচের দিক সাদাটে থেকে হলদে। দেহের উপরের অংশজুড়ে রয়েছে হালকা কালো চওড়া ইংরেজি এক্স (X) অক্ষরের মতো দাগ, যেটি শুরু হয়েছে দুই চোখের পেছন দিক থেকে আর শেষ হয়েছে কোমরে। এ ছাড়া দুই চোখের মাঝামাঝি এবং পায়ের বিভিন্ন স্থানে হালকা কালো দাগ রয়েছে। হাত ও পায়ের আঙুলের মাথায় বড় গোলাকার প্যাড রয়েছে। এই ব্যাঙের চোখের পেছন থেকে কাঁধ পর্যন্ত চামড়ায় লম্বা ভাঁজ রয়েছে, যা দেখে কাছাকাছি প্রজাতি থেকে একে সহজে আলাদা করা যায়। ব্যাঙটি ছোট হলেও এর ডাক যথেষ্ট তীক্ষ্ন। দুটো ছোট পাথর ঠুকলে যেমন টক টক শব্দ হয়, এর ডাক অনেকটা তেমন।’
ড. খান বলেন, ‘এই প্রজাতির ব্যাঙের বেশ কয়েকটির দেখা পেয়েছি বনের নিচের দিকের ঘন ঝোপঝাড়ে। তবে শুধু একটি ব্যাঙের দুই চোখের মাঝখানে (এক চোখ থেকে অন্য চোখ পর্যন্ত) একটি সাদা দাগ ছিল। এটি সম্ভবত একই প্রজাতির মধ্যকার বৈচিত্র্য।’
ভারতের মেঘালয় থেকে সংগৃহীত এই ব্যাঙের ২৪টি নমুনার মধ্যে দুটির পিঠে সাদা দাগ ছিল। এই প্রজাতির ব্যাঙ এর আগে উত্তর-পূর্ব ভারত এবং মিয়ানমারে পাওয়া গেলেও বাংলাদেশে পাওয়া যায়নি। এমনকি Philautus গণের অন্তর্ভূক্ত কোনো প্রজাতির ব্যাঙ এর আগে বাংলাদেশে পাওয়া যায়নি।
যদিও ১৯৮২ সালে প্রকাশিত ওয়াইল্ডলাইফ অব বাংলাদেশ বইয়ে রেজা খান বলেছেন, তিনি এ গণের একটি প্রজাতির নমুনার ডাক শুনেছেন চিরসবুজ বনে।
বান্দরবান জেলার রোয়াংছড়ি থেকে সন্ধানকৃত এই ব্যাঙের নাম Nicobarese Frog । উঁচু একটি পাহাড়ের ওপর অবস্থিত ছোট একটি ডোবার পানিতে পাওয়া এই ব্যাঙটির বৈজ্ঞানিক নাম Hylarana nicobariensis। লম্বাটে মাঝারি আকৃতির ব্যাঙটির দৈর্ঘ্য ৪৯ মিলিমিটার।
এই ব্যাঙের বৈশিষ্ট সম্পর্কে ড. খান বলেন, ‘এই ব্যাঙের ওপরের দিক ধূসর থেকে বাদামি আর নিচের দিক সাদা। ওপরের দিকে বিক্ষিপ্তভাবে কালচে ফোঁটা রয়েছে আর পায়ে রয়েছে কালচে দাগ। মাথার দুই পাশ কালচে বাদামি। বহিঃকর্ণ পর্দা অনেক বড়। এছাড়া দেহের দুই পাশ বরাবর চামড়ার লম্বা ভাঁজ রয়েছে। হাত ও পায়ের আঙুলের মাথায় ছোট গোলাকার প্যাড এবং পায়ের আঙুলগুলোর মধ্যে ঝিল্লি রয়েছে। এর ডাক বেশ জোরালো এবং অনেক দূর থেকে শোনা যায়।’
এই ব্যাঙ মূলত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বাসিন্দা, তবে উত্তর-পূর্ব ভারতের মিজোরাম ও অরুণাচলে বিক্ষিপ্তভাবে পাওয়া যায়।
বাংলাদেশে এ পর্যন্ত প্রায় ৫০ প্রজাতির ব্যাঙ পাওয়া গেছে, তবে বাস্তবে এ প্রজাতির সংখ্যা অনেক বেশি। এসব ব্যাঙ মানুষের নজর এড়িয়ে কোনো নিভৃত অথবা জলাশয়ে বসবাস করে আসছে বলে জানান ড. খান।
ব্যাঙের সংরক্ষণ সম্পর্কে ড. মনিরুল হাসান খান বলেন, ‘বাংলাদেশের সর্বপ্রকার ব্যাঙ আমাদের ফসলের ক্ষতিকর পোকামাকড় খেয়ে প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা করে। বাংলাদেশে কোন প্রজাতির ব্যাঙ কোথায় আছে, কি অবস্থায় আছে তার কোন ডাটাবেজ নেই। জরুরি ভিত্তিতে জরিপ চালিয়ে বিপন্ন ব্যাঙের আবাসস্থলগুলো চিহ্নিত করতে হবে এবং ওই স্থানগুলো ব্যাঙের অভয়াশ্রম হিসেবে রক্ষা করতে হবে। তাহলেই ব্যাঙ রক্ষা করা সম্ভব হবে।’