ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ তিন দিনের সফরে ঢাকায় আসছেন। ভারতের নতুন সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে এটা তার একক প্রথম বিদেশ সফর। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ভারত সফরের আমন্ত্রণপত্র দিতে এসে মোদি সরকারের সুবার্তা পৌঁছাবেন তিনি। সাবেক কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকারের চেয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে এই মোদি সরকারের সম্পর্ক যে আরো বেশি শক্তিশালী সে বার্তা পাওয়া যাবে এই সফর থেকেই।
বুধবার উত্তর-পূর্ব ভারতের প্রভাবশালী দৈনিক যুগশঙ্খ এ খবর দিয়েছে।
পত্রিকাটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে নতুন সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই দুই দেশের বিভিন্ন মহলে জল্পনা চলছে ঢাকা-দিল্লি সম্পর্কের ধরন কেমন হবে তা নিয়ে। বিশেষ করে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকারের আমলে দু’দেশের মধ্যে সম্পর্ক যেভাবে উচ্চমাত্রায় পৌঁছে ছিল, মোদি সরকার তা ধরে রাখবে কিনা এটা নিয়ে আলোচনার শেষ নেই। এ প্রেক্ষাপটে সব জল্পনার অবসান ঘটবে সুষমা স্বরাজের এই সফরে। সঙ্গে আগামী পাঁচ বছরের জন্য দু’দেশের সম্পর্কে রূপরেখা চুড়ান্ত হবে।
যুগশঙ্খের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সুষমা স্বরাজ বাংলাদেশের শীর্ষ নেতৃত্বকে বুঝিয়ে দেবেন যে, সরকার বদল হতেই পারে; কিন্তু মোদি সরকারের বিদেশনীতিতে অগ্রাধিকার পাবে বাংলাদেশসহ প্রতিবেশী দেশগুলো।
এ সফরে ভারত-বাংলাদেশের পারস্পরিক সহযোগিতার সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনাও স্পষ্ট হবে। উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলোর জন্য ট্রানজিট-ট্রান্সশিপমেন্টসহ ব্যবসা-বাণিজ্যের নানা দিক নিয়েও সবিস্তার আলোচনা করবেন বাংলাদেশের শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে। আলোচনা হবে গুরুত্বপূর্ণ দ্বিপাক্ষিক, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বিষয় নিয়েও।
বলা বাহুল্য, অনেকেরই ধারণা যে, এ দুটি দেশের সম্পর্ক সরকার-কেন্দ্রিক। কিন্তু ঢাকার সঙ্গে দিল্লির সুসম্পর্ক ঐতিহাসিক এবং তা দাঁড়িয়ে আছে উভয় দেশের অভিন্ন জাতীয় স্বার্থের ওপর। এ কথাও ঠিক যে, একাধিক ইস্যুর সফল রূপায়ণ এখনো ঝুলে আছে, যার একটা সন্তোষজনক এবং গ্রহণযোগ্য সমাধান হওয়া দরকার। আর আলোচ্য সফরে সেটাই হবে সুষমা স্বরাজের প্রথম পদক্ষেপ।
পত্রিকাটির প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের চাওয়া তিস্তা নদীর পানিবণ্টন, যেটাকে পণবন্দি করে রেখেছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়। দ্বিতীয় ইস্যু স্থলসীমা চুক্তি তথা ভারত-বাংলাদেশ ছিটমহল হস্তান্তর। মোদির শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী মোদির বৈঠকে বকেয়া দুটি চুক্তি প্রাধান্য পেয়েছে। মোদির কথা দিয়েছেন যে, চুক্তি দুটি কার্যকর করতে তার সরকার ইতিবাচকভাবে বিবেচনা করবেন।
আর তারপরই চুক্তি দুটি রূপায়নের সম্ভাবনা নতুন করে খতিয়ে দেখতে পররাষ্টমন্ত্রী সুষমা স্বরাজকে নির্দেশ দেন তিনি। চুক্তি দুটি কার্যকর করতে মোদি সরকার যে বাস্তবিক আন্তরিক, সেই বার্তা নিয়েই যাচ্ছেন সুষমা স্বরাজ। তবে এর জন্য সময়সীমা বেঁধে দেয়া হয়ত সম্ভব হবে না। ভারতের স্বরাষ্ট্রসচিবের কথায়, ‘‘নিরাপত্তা, সীমান্ত সহযোগিতা এবং ভারত-বিরোধী জঙ্গি সংগঠনগুলি দমনে ঢাকা যেভাবে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে, প্রধানমন্ত্রী তার ভূয়সী প্রশংসা করেন। ওই চুক্তির জন্য সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন ছিল। তার জন্য দরকার ছিল সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা। কিন্তু মনমোহন সিং সরকারের কৃতিত্বকে আটকাতে শেষ পর্যন্ত বেঁকে বসে বিজেপি। এবার হয়ত সেই কৃতিত্বই নিতে চাইবে মোদি সরকার।
অন্যান্য যেসব বিষয় আলোচনায় উঠে আসবে বলে মনে করা হচ্ছে, তার মধ্যে আছে নদী পরিবহন, রেল সংযোগ, শিলং হয়ে ঢাকা-গুয়াহাটি বাস সার্ভিস। বাংলাদেশের নির্বাচিত নাগরিকদের জন্য ‘মাল্টিপল এন্ট্রি ভিসা’ এবং ‘ওয়ার্ক পারমিট’ দেয়ার বিষয়টি নিয়েও দিল্লি চিন্তা-ভাবনা করছে। তার সঙ্গে সঙ্গে নূর হোসেন নামের বাংলাদেশের এক খুনি, যাকে গত সপ্তাহে কলকাতায় গ্রেফতার করা হয়, তাকে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের হাতে প্রত্যর্পণ করতে ভারত রাজি আছে বলেও জানানো হবে। আলোচনায় উঠে আসবে উলফার সারাধণ সম্পাদক অনুপ চেটিয়ার প্রত্যর্পণের বিষয়টিও।
যুগশঙ্খের প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, বাংলাদেশিদের জন্য ভিসা সহজীকরণের বিষয়টি যে গুরুত্ব পাবে সেটা আগেই আভাস পাওয়া গেছে ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় ডেপুটি হাইকমিশনার সন্দীপ চক্রবর্তীর কথায়। ঢাকায় একটি আলোচনায় তিনি বলেছেন, বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের সফর খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ নিয়ে আমরা খুবই আশাবাদী। তিনি অনেক ইতিবাচক বার্তা নিয়ে আসছেন।
তার বার্তার প্রধান বিষয়ই থাকবে, ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্ক জোরদার করার ক্ষেত্রে নতুন সরকারের আগ্রহ। ভারতের সম্পর্ক বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে, কোনো সুনির্দিষ্ট শাসনামলের সঙ্গে নয়। সীমান্ত চুক্তি, ভিসা সহজীকরণ, তিস্তা এবং অর্থনৈতিক ও ব্যবসায়িক কার্যক্রম নিয়ে ঢাকার সঙ্গে আলোচনা হবে। ভিসা প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, বর্তমানে যে ভিসা পদ্ধতি চালু আছে, এর থেকেও সহজ করা হবে।
বুধবার রাতে সুষমা স্বরাজ তিনদিনের সফরে ঢাকায় আসবেন। ফিরবেন শুক্রবার। এ সফরে তিনি বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলীর সঙ্গে বৈঠক করবেন। এ ছাড়া তিনি রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাত করবেন। বিএনপি নেত্রী ও প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গেও তার বৈঠকের কথা রয়েছে।