নবীজির বক্ষবিদারণ

নবীজির বক্ষবিদারণ

বক্ষবিদারণ শব্দটি উচ্চারণের সাথে সাথে আমাদের চিন্তা চলে যায় দেড় হাজার বছর আগে ইতিহাসের একটি বাঁকে। ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে আরব ভূমিতে জন্ম নিয়েছিলেন সৃষ্টির সেরা আল্লাহর পেয়ারা সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মদ মুস্তাফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। কক্ষবিদারণকে আরবিতে বলা হয় ‘শাক্কুস সাদর’, ফার্সি ও উর্দুতে ‘সীনা চাক’। চাক মানে চিরা। ছুরি দিয়ে কোনো জিনিষ চিরা হয় বিধায় ফার্সি ও উর্দুতে বলা হয় চাকু। নবীজির জীবনে বক্ষবিদারণের ঘটনা ঘটেছিল একবার নয়, দুই বা তিন বার। প্রথমবার তার বুক চেরা হয়েছিল শৈশবে চার বছর বয়সে। দ্বিতীয়বার হেরা পর্বতের উপরিস্থ গুহায় ধ্যানমগ্নতায় আল্লাহর পক্ষ হতে ওহী লাভের সূচনা পর্বে। তৃতীয়বার বক্ষবিদারণ হয়েছিল মে’রাজ উপলক্ষে উর্ধ্বজগত পরিভ্রমণের প্রস্তুতি পর্বে। তখন হযরতের বয়স ৫০ বছরের বেশি।
আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে ওপেন হার্ট সার্জারির প্রসার ঘটায় ‘শাক্কে সদর’ এর ব্যাপারটি বুঝা সহজ হয়েছে। তবে নবীজি (সা.) এর বেলায় ব্যাপারটি ছিল অলৌকিক। এর পেছনে আয়োজন ছিল অতি-প্রাকৃতিক। সার্জন ছিলেন আল্লাহর ফেরেশতা। অপারেশনের আগে চেতনা বিলোপের ঔষধ প্রয়োগের প্রয়োজন হয়নি। ফলে ঘটনার আদ্যোপান্ত হযরতের গোচরেই সম্পন্ন হয়েছে এবং তিনি একটুও অচেতন হননি। আবার অপরেশন-উত্তর তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ সুস্থ, আগের চাইতে প্রাণবন্ত। হযরতের বক্ষ বিদারণের কারণ নিয়ে গবেষকগণ অনেক কথা বলেছেন। মূল কথাটি হলো, হযরতের মানবীয় সত্তায় মন্দ ও দুর্বল কোন কোষ থাকলে, তা অপসারণ করে নবুয়াতের দায়িত্ব পালন বা সাত আসমান পাড়ি দিয়ে ‘সিদরাতুল মুনতাহা’ অতিক্রম করে আল্লাহর সান্নিধ্যে উপনীত হওয়ার রূহানী শক্তি ও মনোবল ভরে দেয়া। আমরা প্রথমে হযরতের শৈশবের বক্ষবিদারণের ঘটনার ওপর আলোকপাত করব।
নবীজি (সা.) জন্মেছিলেন মক্কা নগরীতে কুরাইশ বংশে। অভিজাত কুরাইশ বংশের অতি সম্মানিত গোত্র হাশেমী শাখার প্রবাদ-প্রতীম পুরুষ আব্দুল মুত্তালিব তখনো জীবিত। তার দশম পুত্র হযরত আব্দুল্লাহর ঘরে মা আমেনার কোলে জন্মেছিলেন সৃষ্টির সেরা সুন্দর ফুল মুহাম্মদ রাসুল (সা.)। আরব ঐতিহ্যের নিয়ম মাফিক প্রকৃতির কোলে বেড়ে ওঠার জন্যে শিশু মুহাম্মদকে তুলে দেয়া হয় পেশাদার ধাত্রী হালিমার কাছে। শিশু মুহাম্মদের আগমনে সচ্ছলতার আনন্দে আলোকিত হয় হালিমার জীর্ণ কুঠির। প্রকৃতির কোলে অন্য সাথীদের সাথে বেড়ে উঠলেও মুহাম্মদের চলন বলনের ধরণ ছিল আলাদা। তাই মা হালিমা ও তার স্বামী ‘হারেস’এর সমগ্র মনযোগ নিবদ্ধ ছিল কুরাইশী এই শিশুটির প্রতি। প্রাত্যহিক নিয়মে মুহাম্মদ অন্য ভাইদের সাথে একদিন মেষ চরাতে গেছেন অদূরে চারণভূমিতে। হঠাৎ সাথীরা লক্ষ্য করে শ্বেত-বসন দু’জন লোক ধরে নিয়ে গেছে কুরাইশী ভাইটিকে। দৌঁড়ে ঘরে এসে খবর দেয় তারা মা হালিমা ও তার স্বামীকে। প্রাণটা হাতের মুঠোয় নিয়ে দৌঁড় দেয় দু’জনে মুহাম্মদের সন্ধানে। দেখে সুবোধ ছেলেটির চেহারা বিবর্ণ। মুসলিম শরিফের রেওয়ায়তটি এখানে প্রণিধানযোগ্য-
আনাস ইবনে মালিক (রদ.) বর্ণনা করেন, নবী করীম সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে (নবুয়াতের আগে ফেরেশতা) জিব্রাঈল আগমন করেন, তখন তিনি ছেলপেলেদের সাথে খেলছিলেন। ফেরেশতা তাকে ধরে মাটিতে শুয়ে তার হৃদপিন্ডটি বের করেন। তা থেকে একটি রক্তপিন্ড বের করে নেন। ফেরেশতা বলেন, এ হচ্ছে তোমার ভেতরকার শয়তানের অংশ। অতপর হৃদপিন্ডটি সোনার তশতরীতে নিয়ে জমজম এর পানি দিয়ে ধৌত করেন। তারপর জোড়া লাগিয়ে আগের জায়গায় প্রতিস্থাপন করেন। এ দৃশ্য দেখে ছেলেরা দৌঁড়ে ধাত্রীমা হালিমার কাছে এসে বলে: মুহাম্মদকে হত্যা করা হয়েছে। তারা দ্রুত গিয়ে দেখে, তার চেহারার রং বিবর্ণ। বর্ণনাকারী আনাস বলেন, হযরতের বক্ষে পরবর্তীতেও সিলাইয়ের চিহ্ন দেখা যেত। (মুসলিম, ২৪০/১৬৪)।। অন্যান্য  সূত্রের বর্ণনায় ফেরেশতার সংখ্য্য ছিল দু’জন আর তার হৃদপিন্ড ধোয়া হয়েছিল বরফ দিয়ে। এই অপারেশনের বিবরণ দিয়েছেন স্বয়ং রাসূলে আকরাম (সা.)।  এ ঘটনায় বিচলিত হয়ে পড়ে হালিমা দম্পতি। আতংকিত হয়, না জানি কোন জিন ভুতের আছর হয়েছে কিনা। কিন্তু প্রাণ-উচ্ছল শিশু মুহাম্মদকে দেখে আঁচ করা যায় না এর কোন আলামত। দ্বিধা-থরথর হালিমা সিদ্ধান্ত নেন, কোন দৈব দুর্ঘটনার আগে শিশু মুহাম্মদকে ফিরিয়ে দিতে হবে মক্কায়।

ইসলামী জগত