প্রতি বছরের বইমেলায় হাতে গোনা তিন-চারটি ভালো মানের উপন্যাস হয়তো প্রকাশিত হয়। কিন্তু সেগুলো `লালসালু`, `কাঁদো নদী কাঁদো`, কিংবা `খোয়াবনামা`, চিলেকোঠার সেপাই কিংবা আগুনপাখিকে ছাড়িয়ে যেতে পারছে না।
হয়তো বিক্রির রেডর্ক ছাড়িয়ে যাচ্ছে কিন্তু তা বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে কতোটা অবদান রাখছে, তা হয়তো বিজ্ঞজনরাই ভালো বলতে পারবেন। তারপরও এবারও উপন্যাস প্রকাশে রেকর্ড ছাড়াবে বলে মনে করছেন প্রকাশকরা।
সাহিত্যবোদ্ধারাও মনে করছেন, বর্তমানে একটা বন্ধ্যাকাল চলছে বাংলা উপন্যাস চর্চার ক্ষেত্রে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আজকাল উপন্যাসের নামে যেসব প্রকাশিত হয়, তা পাঠে পাঠকের মানসিক কোনো উৎকর্ষ সাধন হয় না। খবরের কাগজে চটকদার বিজ্ঞাপন দেখে পাঠক এসব উপন্যাস কেনার প্রতি আগ্রহী হন। যৌনতার প্রলেপ মাখানো এসব উপন্যাস পড়ে পাঠক সাময়িক আনন্দ পান। এছাড়া প্রাপ্তি বলতে আর কিছু নেই।
বাংলা একাডেমীর তথ্যানুযায়ী, গত বছর মেলায় এসেছে ৪৯১টি উপন্যাস। এবারের বইমেলায় অষ্টম দিন পর্যন্ত মেলায় এসেছে ১৪২টি উপন্যাস। প্রকাশকরা জানিয়েছেন, উপন্যাস প্রকাশের ক্ষেত্রে গতবারের রেকর্ড ছাড়িয়ে যাবে এবার।
বেশ কয়েকজন প্রকাশকও অকপটে স্বীকার করেছেন, উপন্যাসে বিরহের কাতরানি, যৌনতার প্রলেপ, প্রচ্ছদে একটু রোমান্টিকতা থাকলেই পাঠক এসব বই বেশি কিনছেন।
দেশের খ্যাতনামা এক প্রকাশক জানান, তার প্রকাশনী থেকে নামকরা কবির কবিতার বই বের করলেও তা সারা বইমেলায় এক্শÕর নিচে বিক্রি হচ্ছে। অথচ অখ্যাত কোনো লেখকের উপন্যাসে রোমান্টিক কোনো নাম এবং ভিতরে যৌনতার গন্ধ থাকলেই তা একদিনেই পঞ্চাশ কপির ওপর বিক্রি হয়।
এছাড়া বর্তমানে কিছু শিল্পপতি রয়েছেন, যারা লেখক হিসেবে স্বীকৃত পেতে মরিয়া হয়ে উঠছেন। তাদের লেখা উপন্যাস মানসম্মত হলো কি হলো না এটা বিষয় নয়, দৃষ্টিনন্দন প্রচ্ছদ আর কাগজের দৈনিক ও ম্যাগাজিনে বাহারি বিজ্ঞাপন দিয়ে সাধারণ পাঠকদের বই কিনতে প্রলুব্ধ করছেন। বইমেলায় হাঁটতে গেলে পায়ের নিচে পড়ে এসব লেখকদের বইয়ের লিফলেট। পাঠক সেই বিজ্ঞাপন দেখে আকৃষ্ট হন। বাংলা একাডেমীর বইমেলায় পাবলিক টয়লেটের প্রবেশ পথেও এসব বইয়ের বিজ্ঞাপন রয়েছে। টয়লেটের দরজায়ও এসব বইয়ের প্রচ্ছদ ও বাহারি ডিজাইনের বিজ্ঞাপন শোভা পাচ্ছে।
সাহিত্যের এই শাখাটির (উপন্যাসের) পাঠক সবচেয়ে বেশি। হুমায়ূন আহমেদ, ইমদাদুল হক মিলন ও মোহিত কামালের উপন্যাস প্রতিবছরই বিক্রির শীর্ষে থাকে। বইমেলায় কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলনের সঙ্গে কথোপকথনের এক পর্যায়ে তিনি বলেন, Ôবইমেলায় অসংখ্য উপন্যাস আসছে… আরও আসবে। এতো উপন্যাসের মধ্যে ৫টি উপন্যাসও যদি মানসম্মত হয় তাহলে তা বাংলা সাহিত্যের সম্পদ হয়ে থাকবে।
কিছু কিছু তরুণ শিল্পমানসম্পন্ন উপন্যাস রচনায় এগিয়ে এসেছেন। তাদের কিছু ভালো উপন্যাস এবারও রয়েছে। তবে সেই তালিকা খুব একটা দীর্ঘ নয়। এর বাইরে মেলা উপলক্ষে যেসব উপন্যাস প্রকাশিত হয় সেগুলোর অধিকাংশই আদৌ কতোটা উপন্যাস হয়ে উঠছে, সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।
উপন্যাসের পর বিদেশি সাহিত্যের অনুবাদের বই সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়, যদিও অনুবাদের ক্ষেত্রে পুরোপুরি শর্ত মানা হয় না। এরপর আছে আত্মজীবনী বা স্মৃতিকথা। বিক্রির ক্ষেত্রে আত্মজীবনী বা স্মৃতিকথা তৃতীয় সারিরই বলা চলে। কোনো তরুণ এ ধরনের বই লেখেন না, দেশের প্রতিষ্ঠিত লেখকরাই এর লেখক। এগুলো পাঠের মধ্য দিয়ে পাঠক সমৃদ্ধ হন, তাদের বোধ উন্নত হয়। অগ্রজদের জীবন থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজেদের সুন্দর জীবন গঠনে প্রয়াসী হন।
চতুর্থ ধারায় রয়েছে প্রবন্ধ। অগ্রসর পাঠকরা প্রবন্ধ পাঠে উৎসাহী। পঞ্চম ধারায় রয়েছে শিশু সাহিত্য। হাজার হাজার শিশু মেলায় আসে। ছেলে-মেয়েদের আবদার রক্ষার্থে প্রায় প্রত্যেক মা-বাবাই তাদের সন্তানকে একটি বই কিনে দেন। আর সেটি নিশ্চিত ভাবেই শিশুতোষ বই। অপরদিকে, সবচেয়ে কম বিক্রি হয় ভ্রমণ বিষয়ক বই, গল্প, কবিতা আর নাটকের বই। সমকালে চর্চিত ভ্রমণসাহিত্য ঠিক ওইভাবে এখানো পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়নি। আর প্রতিষ্ঠিত গল্পকার না হলে পাঠক গল্পের বই কেনার প্রতি তেমন একটা আগ্রহী হন না।
প্রতি বছরই বেশি প্রকাশিত হয় উপন্যাস ও কবিতার বই। তবে সবচেয়ে বিক্রি বেশি হয় উপন্যাস আর কবিতা ও নাটকের বই সবচাইতে কম। নাটকের পাঠকের চেয়ে দর্শকের সংখ্যাই বেশি। ফলে নাটকের বইয়ের ক্রেতা সংখ্যা একেবারেই সীমিত।