বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত তা নিঃসন্দেহে বলে দেয়া যায়। সামনে ব্যাপক আকারে সহিংসতা হবে। বিশেষ করে তা নির্বাচনের সময়ে বেশি হবে। কারণ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে বিরোধিতা করছেন বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া। অনেক মানুষ মনে করেন, কয়েক বছর আগের মতো দেশে সেনাবাহিনী আসতে পারে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে চার-পঞ্চমাংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে কিভাবে ক্ষিপ্রতার সঙ্গে তা অপচয় করেছেন তাতে আমি বিস্মিত হয়েছি। তার অপশাসন বাড়িয়েছে দুর্নীতি। এমনকি গ্রাম পর্যায়ে সরকারি যন্ত্রগুলোকে তা সংক্রমিত করেছে। খালেদা জিয়া পরিস্থিতিকে উত্তপ্ত করে তুলেছেন প্রতি তিন দিনে একদিন হরতাল করে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সাধারণ মানুষ। শেখ হাসিনা যখন ক্ষমতার বাইরে ছিলেন তখন তিনিও হরতাল করেছেন। আমি ঢাকায় পৌঁছানোর কয়েক মিনিটের মধ্যে এক রকম বিতর্কের মধ্যে পড়লাম। সে বিতর্ক হলো আগামী ৫ই জানুয়ারি বাংলাদেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে কিনা তা নিয়ে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এরই মধ্যে গঠন করেছেন সর্বদলীয় অন্তর্বর্তী সরকার। তিনি তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)’র নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে এ সরকারে যোগ দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু খালেদা জিয়ার সমস্যা হলেন শেখ হাসিনা।
আমি ৫ দিন অবস্থান করেছি বাংলাদেশে। এরপর আমি বলতে পারি, যদি খালেদা জিয়া বর্জন করেন তাহলেও নির্বাচন সুষ্ঠু হবে। দৃশ্যত, তিনি নির্বাচন বর্জন করবেন বলেই বেশি মনে হচ্ছে। শেখ হাসিনা পদত্যাগ করতে রাজি নন। পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে তিনি ক্ষমতা ধরে রাখতে যে কোন পদক্ষেপ নেবেন। নির্বাচন তদারকের জন্য সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ছিল সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে তিনি তা বাতিল করে দিয়েছেন।
এই দু’নেত্রী পর্যায়ক্রমে প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। তারা প্রথম বারের মতো টেলিফোনে একে অন্যের সঙ্গে কথা বলেছেন। তাতে কোন সাফল্য আসে নি। এমন কি মধ্যস্থতায়ও সাফল্য আসেনি। এর কারণ তাদের মধ্যে ব্যক্তিগত বৈরিতা। যখন শেখ হাসিনা ক্ষমতার বাইরে ছিলেন তখন তার এক সভায় হামলার ঘটনায় বেগম খালেদা জিয়ার ঘনিষ্ঠ সহযোগীরা জড়িত বলে যে সন্দেহ আছে তা সমর্থনের যথেষ্ট প্রমাণ আছে।
সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছে জামায়াতে ইসলামী। তারা সমাজের প্রতিটি স্তরে প্রভাব বলয় সৃষ্টি করেছে। এমনকি গোয়েন্দাদের মধ্যেও। বিএনপি জামায়াতের ওপর নির্ভর করায় তাতে সুবিধা পেয়েছে জামায়াত। বেগম খালেদা জিয়ার সরকারে এ দু’টি দল এক জোটে ছিল। বিএনপি যদি ফের ক্ষমতায় আসে তাহলে তারা আবারও জোট গড়তে পারে।
এর মধ্য দিয়ে সৃষ্টি হয়েছে জঙ্গিত্ব। ধর্মীয় নেতাদের বক্তব্যের মাধ্যমে তার বিস্তার ঘটছে। শেখ হাসিনা তার প্রধান অগ্রাধিকার দিয়েছেন জঙ্গিদের বিরুদ্ধে লড়াইকে- এর কৃতিত্ব শেখ হাসিনার। তিনি তার পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের ধর্মনিরপেক্ষতার দিকেই ফিরে গিয়েছেন। এ জন্য শেখ হাসিনার প্রতি ভারতে জনপ্রিয়তা এনে দিয়েছে। তবে নরেন্দ্র মোদি ভারতে ধর্মনিরপেক্ষতার ওপর ছায়া ফেলেছেন। বাংলাদেশেও তেমনটা করেছেন খালেদা জিয়া। কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর মূলনীতি নেয়া হয়েছিল যে এখানে রাজনীতির সঙ্গে ধর্মকে মিশিয়ে ফেলা হবে না। এ দেশটির কাছে এই আশাই করা হয়। কিন্তু এখন বাংলাদেশে দেখা যাচ্ছে এর পুরোপুরি ভিন্ন এক চিত্র।
বামদের উপস্থিতি অনুভূত হয় ব্যাপকভাবে। এক সময়ে বাংলাদেশে ছিল একটি শক্তিশালী কমিউনিস্ট পার্টি। এখন তা কমতে কমতে অবশিষ্টাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। তারা এখন সরকারের দিকে ঝুঁকে আছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে ভারত সহ পুরো উপমহাদেশে এটাই অভিন্ন কাহিনী। বামপন্থিদের কি পুনরুত্থানের কোন আশা আছে? এ উপমহাদেশের শতকরা ৭০ ভাগ মানুষ ধর্মীয় ধ্যান-ধারণার বাইরে। এই সুযোগ ব্যবহার করতে পারে বামেরা।
বছরের পর বছর আমার আত্মবিশ্বাস বেড়েছে। জনগণের মাঝে বেড়েছে আশা। অভ্যন্তরীণ টালমাটাল পরিস্থিতি সত্ত্বেও গত এক দশকে বাংলাদেশ জাতীয় প্রবৃদ্ধি শতকরা ৬ ভাগ ধরে রেখেছে। কৃষিতে উৎপাদন বৃদ্ধি বাংলাদেশকে আত্মনির্ভরশীল করেছে। গার্মেন্ট শিল্পে শ্রম আইন অনুসরণ করা না হলেও তার বিস্তার ঘটছে।
কয়েক বছর আগে সেনাবাহিনী সমর্থিত সরকার ক্ষমতায় এলেও যখন তারা দেখেছে জনগণ গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাশীল তখনই তারা সরে গিয়েছে। এই গণতন্ত্রকে বিকৃত করেছেন দু’নেত্রী।
একজন শীর্ষ স্থানীয় সম্পাদক এক্ষেত্রে বিচার বিভাগের হস্তক্ষেপ চান। তিনি বলেন, আমাদের সংবিধান ও নাগরিকের অধিকার রক্ষার মালিক বিচার বিভাগ। এখন তারা ছাড়া আমাদের আর যাওয়ার কোন জায়গা নেই।
লেখক: কুলদীপ নায়ার ভারতের সাবেক কূটনীতিক, সাংবাদিক ও কলাম লেখক।
গতকাল পাকিস্তানের দ্য এক্সপ্রেস ট্রিবিউনে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশজ পলিটিক্যাল ফিউচার’ শীর্ষক লেখার অনুবাদ।