জিএসপি প্রত্যাহার চায় মার্কিন সিনেট কমিটি

জিএসপি প্রত্যাহার চায় মার্কিন সিনেট কমিটি

বাংলাদেশকে দেয়া জিএসপি প্রত্যাহার করতে চাইছে মার্কিন সিনেট কমিটি। তারা বলছেন, শ্রমিক অধিকার ও নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতেই এটা দরকার। মার্কিন শ্রমিক সংগঠনগুলোও জিএসপি বাতিলের পক্ষে। তবে মর্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্লেক জিএসপি বহালের পক্ষে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ সরকার অনেক ব্যবস্থা নিচ্ছে। এখন শুনানি চলছে, চলতি মাসের শেষে সিদ্ধান্ত হতে পারে।

পণ্য রপ্তানিতে বাংলাদেশকে দেয়া অগ্রাধিকারমূলক বাজার সুবিধা (জিএসপি) প্রত্যাহারের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটের পররাষ্ট্র সম্পর্কিত কমিটি। বৃহস্পতিবার ওয়াশিংটনে সিনেট কমিটির এক শুনানিতে জিএসপি সুবিধা থেকে বাংলাদেশকে বাদ দেয়ার জোরালো সুপারিশ করেন এই কমিটির চেয়ারম্যান সিনেটর রবার্ট মেনেনডেজ। তিনি বলেন, বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাক যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে জিএসপি সুবিধা পায় না। এই সুবিধা প্রত্যাহার করা হলে বাংলাদেশের রপ্তানি খাতের ক্ষুদ্র একটি অংশই কেবল ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। কাজেই জিএসপি বাতিল করা হলে বাংলাদেশ একটি জোরালো সংকেত পাবে যে, যুক্তরাষ্ট্র শ্রমিক অধিকারের সুরক্ষা এবং কারখানার নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিতের বিষয়ে যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়।

তবে শুনানিতে যুক্তরাষ্ট্রে মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী রবার্ট ও’ব্লেক শ্রমিক ইউনিয়নসহ বাংলাদেশের গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপের প্রশংসা করে জিএসপি সুবিধা অব্যাহত রাখার পক্ষে মত দেন। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমিক সংগঠনগুলোর বৃহত্তম এলায়েন্স এএফএল-সিআইও’র প্রতিনিধি শুনানিতে বলেন, বাংলাদেশকে জিএসপি সুবিধা অব্যাহত রাখার মানেই হচ্ছে শ্রমিকদের জীবন নিয়ে খেলা করা। কারণ ইতিপূর্বে বাংলাদেশ তার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছে।

তবে বাংলাদেশের পণ্য আগামীতে জিএসপি সুবিধা পাবে কি না—সেই সিদ্ধান্ত জানা যাবে চলতি মাসের শেষে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র বিষয়ক সিনেট কমিটি জানিয়েছে, বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা, কমিয়ে আনা অথবা এই সুবিধা পুরোপুরি প্রত্যাহার—এই তিনটি বিকল্প বিবেচনা করা হচ্ছে। জিএসপি সুবিধা বাতিলের বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের গুরুত্বের সঙ্গে নেয়া উচিত বলে মন্তব্য করেন ডেমোক্রাট দলের সিনেটর মেনেনডেজ। যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেড রিপ্রেজেনটেটিভ অফিসের শ্রমিক অধিকার উইংয়ের প্রধান লুইস কারেশ শুনানিতে জানান, বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধা পর্যালোচনার পর এ মাসের শেষভাগে সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হবে।

শুনানিতে ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত একরামুল কাদেরও উপস্থিত ছিলেন। সিনেটের সকালের অধিবেশনে শুনানিতে আরো উপস্থিত ছিলেন সিনেটর বব কোর্কার, বর্ষীয়ান সিনেটর জন ম্যাককেইন, সিনেটর রবার্ট ক্যাসি এবং ফরেন রিলেশনস কমিটির সর্বকনিষ্ঠ সদস্য সিনেটর টিম কেইন।

বাংলাদেশের শ্রমিক অধিকার নিয়ে আয়োজিত এ শুনানিতে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের নিরাপত্তা বিধানে সংশ্লিষ্ট সবার যৌথ সহযোগিতার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। সিনেট কমিটির সভাপতি সিনেটর রবার্ট মেনেনডেজ এ বিষয়ে বলেন, এটা মনে করার কারণ নেই যে, বাংলাদেশ বিষয়ক শুনানিটি ‘ওয়ান গুড নাইট হিয়ারিং’ এবং একদিনের শুনানিতেই এ বিষয়ে সিদ্ধান্তে আসা যাবে। বরং বিষয়টির জটিলতা ও গুরুত্ব এতো বেশি যে, এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে সিনেটকে আরো কয়েকবার শুনানি করতে হতে পারে।

উদ্বোধনী বক্তব্যে সিনেটর মেনেনডেজ বলেন, বাংলাদেশ একটি উদার মুসলিম গণতান্ত্রিক দেশ। বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ৬ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি বাণিজ্যিক সম্পর্ক রয়েছে। উত্তর নিউজার্সির একজন সেলাই কর্মীর সন্তান হিসেবে আমি জানি শ্রমিক নিরাপত্তার বিষয়টি কতটা গুরুত্বপূর্ণ ও কঠিন। কিন্তু জিএসপি কর্মসূচির আওতায় বাংলাদেশে শ্রমিক অধিকার ও শ্রমিক নিরাপত্তার বিষয়টি ২০০৭ সাল থেকে নিয়মিত পর্যবেক্ষণে থাকার পরও বাংলাদেশ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশি প্রকৌশলীদের জরিপের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশের মোট ৫ হাজার পোশাক কারখানার ৬০ ভাগই ঝুঁকিপূর্ণ। এমন ভয়াবহ অবস্থা উত্তরণে সংশ্লিষ্ট সবার যৌথ প্রচেষ্টা দরকার। এক্ষেত্রে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের মতো মার্কিন গ্লোবাল খুচরা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলোরও আইনি বাধ্যবাধকতামূলক চুক্তি সম্পাদনের মাধ্যমে আরো বৃহত্তর ভূমিকা পালনের সুযোগ রয়েছে।

শুনানিতে প্রথম প্যানেলে বক্তৃতা করেন যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধির কার্যালয়ের এসিস্ট্যান্ট ট্রেড রিপ্রেজেন্টেটিভ ফর লেবার লুইস কারেশ, পররাষ্ট্র দপ্তরের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী রবার্ট ও’ব্লেক, মার্কিন ডিপার্টমেন্ট অফ লেবার-এর ভারপ্রাপ্ত সহকারী ডেপুটি আন্ডার সেক্রেটারি ফর ইন্টারন্যাশনাল এফেয়ার্স এরিক বিয়েল।

দ্বিতীয় প্যানেলে বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশের বাণিজ্য সুবিধা বাতিলের দাবিতে মার্কিন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের জিএসপি বিষয়ক সাব-কমিটির নিকট মূল আবেদনকারী সংগঠন যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমিক সংগঠনগুলোর বৃহত্তম এলায়েন্স এএফএল-সিআইও’র ট্রেড পলিসি স্পেশালিস্ট সিলেস্ট ড্রেইক এবং আন্তর্জাতিক শ্রমিক অধিকার সংগঠনের আইনজীবী জোহান লুবে।

লুইস কারেশ বলেন, বাংলাদেশে গার্মেন্টস ভবন ধস ও অগ্নিকাণ্ডের হূদয় বিদারক ঘটনা বলে দেয় এটা আমাদের সরকার, মার্কিন কোম্পানি ও ক্রেতাদের জন্য একটি কঠিন সময় এবং শ্রমিকদের অধিকার ও নিরাপত্তা রক্ষায় বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করতে হবে। বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তে দেখা যায়, ট্রেড ইউনিয়ন নেতারা ও শ্রমিকদের অধিকার ও নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন এনজিও নানা সময় হয়রানির শিকার হচ্ছে। আমরা এসব অভিযোগ গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করছি। এ বিষয়ে বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলেছি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে উন্নতি হলেও গত বছর কয়েকটি ক্ষেত্রে পরিস্থিতি খারাপ হয়েছে। বিশেষ করে শ্রমিক অধিকার পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়েছে।

এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধা, বাতিল, স্থগিত বা সীমিত করে দেয়ার জোর দাবি উঠেছে। তবে সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী রবার্ট ও’ব্লেক তার বক্তৃতায় বাংলাদেশের সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক সাফল্য, নারী ও শিশু উন্নয়নে বাংলাদেশের ভূমিকা, সন্ত্রাস দমন ও আঞ্চলিক নিরাপত্তা রক্ষায় বাংলাদেশের ভূমিকার ভূয়সী প্রশংসা করেন। তিনি শুনানিতে বলেন, বাংলাদেশ মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে। প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশ অব্যাহত আছে, নারী শিক্ষার হার বেড়েছে, শিশু ও মাতৃমৃত্যু হরাস পেয়েছে। সাম্প্রতিক বাংলাদেশ সফরে আন্ডার সেক্রেটারি অফ স্টেট উয়েন্ডি শ্যারম্যান বাংলাদেশকে একটি ভাইব্রান্ট মুসলিম মেজরিটি বলে উল্লেখ করে বাংলাদেশের উন্নয়ন ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সাফল্য অন্যান্য দেশের জন্য অনুকরণীয় বলে উল্লেখ করেছেন। এমতাবস্থায় বাংলাদেশের উন্নয়নের ধারাকে অব্যাহত রাখার ওপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, পোশাক শিল্পের নিরাপত্তা বিধানে বাংলাদেশ ব্যর্থ হয়েছে। তবে সম্প্রতি বেশ কিছু ভাল উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। একটি সামগ্রিক শ্রম আইনের খসড়া বাংলাদেশের পার্লামেন্টে পাসের অপেক্ষায় রয়েছে। এছাড়া এ পর্যন্ত ২৭টি শ্রমিক ইউনিয়ন নিবন্ধিত হয়েছে। আমিনুল ইসলামের হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা শাখার তদন্তাধীন রয়েছে। পোশাক কারখানাগুলোর নিরাপত্তায় বিজিএমইএসহ সরকারি বেসরকারিভাবে ইন্সপেক্টর নিয়োগের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বেশ কিছু মার্কিন রিটেইলার অগ্নিনিরাপত্তামূলক চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি আগের চেয়ে কিছুটা ভাল। তবে তা যথেষ্ট নয়।

এএফএল-সিআইও’র ট্রেড পলিসি স্পেশালিস্ট সিলেস্ট ডেইক বলেন, বাংলাদেশকে বেনিফিট অফ ডাউটের আওতায় জিএসপি সুবিধা অব্যাহত রাখা মানে শ্রমিকদের জীবন নিয়ে খেলা। বাংলাদেশ সুস্পষ্টভাবে তার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে। আইন পাস করাই শ্রমিকের নিরাপত্তার জন্য যথেষ্ট উদ্যোগ নয়। দেখতে হবে ওই আইন বাস্তবে কতটা কার্যকর এবং আদৌ তা বাস্তবায়ন হচ্ছে কিনা। ২০০৭ সাল থেকে আমরা গভীর উদ্বেগের সঙ্গে খেয়াল করেছি বাংলাদেশ কিভাবে তার প্রতিশ্রুতির বরখেলাপ করেছে। তিনি বলেন, জিএসপির আওতায় বাংলাদেশ অতি নগণ্য পরিমাণ রপ্তানি করে থাকে। এছাড়া জিএসপি বাতিল করলে বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যক নারী বেকার হয়ে পড়বেন বলে যে কথা বলা হচ্ছে তাও সত্য নয়।

যুক্তরাষ্ট্রের বাজারের ১২৫ দেশের সঙ্গে বাংলাদেশও পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে জিএসপি সুবিধা ভোগ করে থাকে। বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর লক্ষ্যে এ সুবিধা প্রদান করা হয়ে থাকে। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশ প্রতি বছর সাড়ে চার বিলিয়ন ডলারের বেশি তৈরি পোশাক রপ্তানি করে থাকে।

অন্যান্য অর্থ বাণিজ্য আন্তর্জাতিক শীর্ষ খবর