প্রস্তাবিত বাজেটের প্রতিক্রিয়ায় দেশের অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, নির্বাচনকে
সামনে রেখে এ বাজেট করা হয়েছে। সবাইকে সন্তুষ্ট করার লক্ষ্য নিয়ে বাজেটে খাতওয়ারি বরাদ্দ রাখা হয়েছে। বর্তমান রাজনৈতিক সঙ্কটকালীন পরিস্থিতিতে বড় আকারের এ বাজেট বাস্তবায়ন নিয়েও সংশয় প্রকাশ করেছেন তারা। অর্থনীতিবিদদের মতে প্রস্তাবিত বাজেট ৩টি সরকার বাস্তবায়ন করবে। যেমন, বর্তমান সরকার, নির্বাচনকালীন সরকার এবং আগামীতে নির্বাচিত সরকারের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হবে।
তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান বলেন, আগামী বাজেট বাস্তবায়নে সরকারের কাছে দু’টি চ্যালেঞ্জ রয়েছে। একটি হলো- রাজনৈতিক অস্থিরতা, অন্যটি রাজস্ব আদায়। নির্বাচন বিষয়ে তিনি বলেন, সরকার যা ব্যয় নির্ধারণ করেছে সেটা বাস্তবায়ন করতে হলে অবশ্যই রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হবে। অবশ্য চলতি অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে সংশয় রয়েছে। এ নিয়ে বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী কোন কথা বলেননি। আকবর আলি খান বলেন, বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতি এমনিতেই চাপের মুখে রয়েছে। সুতরাং, আর্থিক ব্যয় হ্রাস করার সঙ্গে সঙ্গে উচ্চাভিলাষী খরচগুলো সংকোচন করতে পারাটাই বড় বিষয় হিসেবে দেখা দিয়েছে। তিনি বলেন, শুধু বক্তব্য নয়, পরবর্তী সময়ে অর্থমন্ত্রী দেশের অর্থব্যবস্থা কিভাবে পরিচালনা করবেন তার ওপর নির্ভর করবে বাজেটের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হবে কি না। তিনি বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে বাজেটে বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে তা পূরণ হওয়ার সম্ভাবনা নেই। দেশে বিনিয়োগ নেই। পর্যাপ্ত অবকাঠামোর ঘাটতি রয়েছে। আগামী কয়েক মাসে যে অবকাঠামোগত ব্যাপক উন্নতি হবে সেটাও সম্ভব নয়। তিনি বলেন, বাজেটে ৭.২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে, যা গত বছরের তুলনায় বেশি নয়। তবে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রা সোনার হরিণ। বর্তমানে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ স্থবির রয়েছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা আগামী দিনে কতটুকু বিনিয়োগ হবে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হলে বেসরকারি খাতে বিপুল পরিমাণে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। এজন্য ব্যাংকের সুদের হার কম হওয়া একান্ত জরুরি। আর সুদের হার কমাতে ব্যাংকগুলোর সুশাসন নিশ্চিত করা দরকার। কিন্তু গত এক বছরে ব্যাংকিং খাতে সুশাসন ফিরিতে আনতে উল্লেখযোগ্য কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। তাই বিনিয়োগের সম্ভাবনাও দেখছি না। আকবর আলি খান বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটে মূল্যস্ফীতি ধরা হয়েছে ৭ শতাংশ। অর্থমন্ত্রী তার বক্তৃতায় আশা প্রকাশ করেছেন, জ্বালানি তেল, খাদ্য ও সারের দাম বাড়বে না। এগুলো তার অনুমান মাত্র। এছাড়া রাজস্ব আয়ের যে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে সেগুলো পূরণ না হলে বাজেট ঘাটতি আরও বাড়বে, যা মূল্যস্ফীতিতে চাপ ফেলবে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এ বি মীর্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, বাজেট হলো রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনের হাতিয়ার। তার প্রভাব এবারের বাজেটেও থাকতে পারে বলে তিনি মনে করেন। তার মতে, এ বাজেটে বস্তুনিষ্ঠতার অভাব রয়েছে। বৈদেশিক আর্থিক সহায়তা ও ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকার ঋণ নেয়ার যে কৌশল নিচ্ছে তা গ্রহণযোগ্য মনে হচ্ছে না। এডিপি বাস্তবায়নের যে পরিবেশ থাকা দরকার তা-ও বর্তমানে নেই। এছাড়া প্রশাসনিক অদক্ষতা আর দুর্নীতি তো লেগেই আছে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)-এর সিনিয়র ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, সার্বিকভাবে এবারের বাজেট উচ্চাভিলাষী। কারণ, গতবার প্রবৃদ্ধিও যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল, তা অর্জন করা সম্ভব হয়নি। গত অর্থ বছরের প্রবৃদ্ধিও লক্ষ্যমাত্রা এবারের বাজেটেও ধরা হয়েছে। মূল্যস্ফীতি সম্পর্কে তিনি বলেন, মূলস্ফীতি ধরে রাখা নির্ভর করছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা বাজার ও বাংলাদেশ ব্যাংক মুদ্রা সংগ্রহে কি কৌশল নিচ্ছে তার ওপর। উন্নয়ন ব্যয় বলা হচ্ছে বাড়বে তা বাস্তব সম্মত মনে হচ্ছে না। এছাড়া ঘোষিত বাজেটের আয়-ব্যয়ের যৌক্তিকতা নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্নের সুযোগ রয়েছে। রাজস্ব আদায়ের আওতা না বাড়ালে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ নেয়ার প্রবণতা বাড়বে। তিনি বলেন, ব্যয়ের চেয়ে আয় বেশি হওয়া উচিত। তা না হলে ভারসাম্য থাকবে না বাজেটে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটে কোন গুণগত পরিবর্তন নেই। আগের ধারাবাহিকতায় বাজেট দেয়া হয়েছে। তবে এটিকে আমি জনতুষ্টির বাজেট বলবো। তিনি বলেন, বাজেট বড় করা হয়েছে এতে আপত্তি নেই। তবে বিশাল এ ঘাটতির বাজেট বাস্তবায়ন করা কঠিনই হবে।