সরকার ও বিরোধী দলের অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ ও দু’দফা ওয়াকআউটে বাজেট অধিবেশনের তৃতীয় দিন সংসদ ছিল উত্তপ্ত। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক
প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এবং ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদকে নিয়ে বস্ত্রমন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর বক্তব্যে প্রথম দফায় ওয়াকআউট করে বিরোধী দল। পরে পয়েন্ট অব অর্ডারে বিএনপি দলীয় এমপি সৈয়দা আসিফা আশরাফী পাপিয়াকে কথা বলতে না দেয়ায় দ্বিতীয় দফা ওয়াকআউট করেন তারা। আপত্তিকর, অপ্রাসঙ্গিক ও সংসদীয় কার্যপ্রণালী বিধিবহির্ভূত দাবি করে বিরোধীদলীয় এমপিরা টেবিল চাপড়ে, দাঁড়িয়ে ও হৈচৈ করে পাটমন্ত্রীর বক্তব্যের প্রতিবাদ জানান। এ সময় সরকার ও বিরোধীদলীয় এমপিদের হৈচৈয়ে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে সংসদ। এ সময় বিরোধীদলীয় সিনিয়র পার্লামেন্টারিয়ান ব্যারিস্টার মওদুদ ফ্লোর নিয়ে স্পিকারকে বলেন, কার্যপ্রণালী বিধি অনুযায়ী প্রশ্নোত্তরপর্বে অপ্রাসঙ্গিক বিষয়ের অবতারণা করা যায় না। তবে প্রশ্নের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক বিষয়ে বক্তব্য দেয়া যায়। কিন্তু পাটমন্ত্রী প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে অপ্রাসঙ্গিক ও ব্যক্তি আক্রমণ করে বক্তব্য দিয়েছেন। বিরোধী দলের পক্ষ থেকে স্পিকারের প্রতি এমন আহ্বান জানানোর পরও সরকারি দল বিরোধীদলীয় এমপিদের আক্রমণ করে বক্তব্য অব্যাহত রাখেন। একপর্যায়ে দ্বিতীয় দফা ওয়াকআউট করে বিরোধী দল। এদিকে বিরোধীদলীয় সূত্রে জানা গেছে, মহাজোট সরকারের আজকের পঞ্চম বাজেট ঘোষণার দিন সংসদে যোগ দেবে না বিএনপি। বিরোধী দলের অনুপস্থিতিতেই এই নিয়ে মহাজোট সরকারের পাঁচটি বাজেট ঘোষণা করা হচ্ছে। ওদিকে বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া ও বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ জয়নুল আবদীন ফারুক গতকাল অনুপস্থিত ছিলেন সংসদে। গতকাল বিকাল ৫টা ১৮ মিনিটে সংসদ শুরুর পর প্রথমেই সংসদ নেতা প্রধানমন্ত্রীর প্রশ্নোত্তরপর্ব শুরু হয়। প্রায় পৌনে এক ঘণ্টাব্যাপী এ পর্বে বিরোধী দলীয় এমপিরা সংসদে বিরোধীদলীয় নেতার কার্যালয়ে কাটান। প্রধানমন্ত্রীর প্রশ্নোত্তর পর্বের পর অধিবেশন কক্ষে যোগ দেন তারা। শুরুতেই বগুড়া-৩ আসনের বিএনপি দলীয় এমপি আবদুল মমিন তালুকদার খোকা বগুড়া-নওগাঁ মহাসড়কের দুরবস্থা নিয়ে যোগাযোগমন্ত্রীর কাছে প্রশ্ন করেন। যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এর উত্তর দেন।
পাটমন্ত্রীর বক্তব্যের প্রতিবাদে প্রথম দফা ওয়াকআউট
একটি প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে পাট ও বস্ত্রমন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকী বলেন, জিয়াউর রহমান কেবল গণতন্ত্র হত্যা ও রাজনীতিকেই ধ্বংস করেননি- দেশের পাটকলগুলোও ধ্বংস করেছেন। তার বক্তব্যের সঙ্গে সঙ্গে বিরোধীদলীয় চিফ হুইপের দায়িত্বপ্রাপ্ত শহীদউদ্দিন চৌধুরী এ্যানী, জাফরুল ইসলাম চৌধুরী, আশরাফউদ্দিন নিজান, আবুল খায়ের ভূঁইয়াসহ কয়েকজন এমপি দাঁড়িয়ে ও টেবিল চাপড়ে বারবার প্রতিবাদ করতে থাকেন। তারা স্পিকারকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন করেন- পাটমন্ত্রী প্রশ্নের জবাব দিচ্ছেন নাকি বক্তব্য দিচ্ছেন। তিনি অপ্রাসঙ্গিক বক্তব্য দিয়ে সংসদের পরিবেশ নষ্ট করছেন। কিন্তু বস্ত্রমন্ত্রী তার বক্তব্য অব্যাহত রাখলে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। এ পর্যায়ে বিরোধী এমপিরা হৈ চৈ শুরু করেন। এ পর্যায়ে স্পিকার ড. শিরীন শারমীন চৌধুরী বিরোধীদলীয় এমপি ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদকে সম্পূরক প্রশ্নের সুযোগ দেন। ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ দাঁড়িয়ে বলেন, পাটমন্ত্রী যে বক্তব্য দিয়েছেন তা সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক। সংসদীয় কার্যপ্রণালী বিধিবহির্ভূত। প্রশ্নোত্তর পর্বে তিনি মন্ত্রী হিসেবে প্রশ্নের উত্তর দেবেন। অপ্রাসঙ্গিক বিষয় টেনে এনে বক্তব্য দেবেন না। কিন্তু পাটমন্ত্রী অপ্রাসঙ্গিক বিষয়ে আপত্তিকর বক্তব্য দিচ্ছেন। ব্যারিস্টার মওদুদ বলেন, আমার কোন সম্পূরক প্রশ্ন নেই। আমি আপনার মাধ্যমে বলতে চাই- সংসদ সুষ্ঠুভাবে চলুক। প্রশ্নের জবাবে যেন মন্ত্রীরা অপ্রাসঙ্গিক বিষয়ে বক্তব্য না দেন। তবে প্রশ্নের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক বিষয়ে মন্ত্রীরা কথা বলতে পারেন। এ সময় বিরোধীদলীয় এমপিরা ‘শেম, শেম’ বলে প্রতিবাদ করেন। এরপর রাজবাড়ীর সরকার দলীয় এমপি কাজী কেরামত আলীর একপ্রশ্নের জবাবে পাটমন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকী দাঁড়িয়ে বিরোধী দলীয় এমপি ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদকে ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করে বক্তব্য দেন। তিনি বলেন, আমি ’৭০ সালে এবং ’৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু সরকারের সংসদেও এমপি ছিলাম। কোনটি প্রাসঙ্গিক আর কোনটি অপ্রাসঙ্গিক সেটা আমাকে বোঝাতে হবে না। বিরোধী দলের এমপি মওদুদ আহমদ বিজ্ঞ আইনজীবী। দেশে সামরিক শাসন জারি না হলে আপনি তো সংসদেই আসতে পারতেন না। পাটমন্ত্রীর এ বক্তব্যের সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়িয়ে যান ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ। তিনি আঙুল নেড়ে পাটমন্ত্রী বক্তব্যের প্রতিবাদ জানান। এ পর্যায়ে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের পাশাপাশি সাবেক স্পিকার জমিরউদ্দিন সরকার ও এমকে আনোয়ারসহ সকল বিরোধী এমপিরা দাঁড়িয়ে যান। এতে ফের উত্তপ্ত হয়ে ওঠে সংসদ। সরকার ও বিরোধী দলীয় এমপিরা পরস্পরকে উদ্দেশ্য করে ‘চুপ, চুপ’ ইত্যাদি শব্দ উচ্চারণ করেন। কিন্তু পাটমন্ত্রী তার বক্তব্য অব্যাহত রাখলে এক পর্যায়ে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের নেতৃত্বে ওয়াকআউট করেন বিরোধী এমপিরা।
নারায়ণগঞ্জে কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণে দরপত্র নিয়ে মওদুদের প্রশ্ন
পয়েন্ট অব অর্ডারে দাঁড়িয়ে বিএনপি দলীয় এমপি ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেন, শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান কোন কলকারখানা বন্ধ করেননি। কিছু কলকারখানার মালিক ছিল বাঙালি। তিনি তাদের সেসব কারখানার মালিকানা ফিরিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু পাটমন্ত্রী শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ও আমার বিরুদ্ধে আক্রমণ করে বক্তব্য দিয়েছেন। তাই আপনার কাছে আমার অনুরোধ পাটমন্ত্রীর বক্তব্যগুলো এক্সপাঞ্জ করা হোক। ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেন, নারায়ণগঞ্জে একটি কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণ নিয়ে ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের ওয়েবসাইটে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। এটা কি সরকারের ব্যর্থতা? গত ১০ই মে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে নারায়ণগঞ্জে একটি কনটেইনার টার্মিনাল নির্মানের কারিগরি দিক যাচাইয়ে একটি আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। এ ঘটনা গণমাধ্যমে প্রকাশের পর দেশবাসী উদ্বিগ্ন। প্রশ্ন হচ্ছে- এই জন্যই কি আমরা ১৯৭১ সালে যুদ্ধ করেছি, জীবন দিয়েছি? মওদুদ বলেন, ভারতের এই দরপত্র আহ্বানের ব্যাপারে আমাদের বিনিয়োগ বোর্ড ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কিছুই জানে না। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ভারত সরকারকে একটি চিঠিও দিয়েছে। এটা ভারতের আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন। তারা যা ইচ্ছা করবে তা আমরা মেনে নেবো এটা হতে পারে না। বিএনপি ক্ষমতায় থাকলে এটা হতো না। তিনি সরকার দলীয় এমপিদের উদ্দেশে বলেন, আমাদের দেশে কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণ করা হবে আর ভারত তার আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করবে তা কি আপনারা মেনে নিচ্ছেন? তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফরে গিয়ে বেশ ক’টি চুক্তি ও ৫০ দফা স্মারক স্বাক্ষর করেছেন। যেসব চুক্তিতে কি আছে তা সংসদে উপস্থাপন না করে তিনি সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন। দেশের কেউ জানে না সে চুক্তিতে কি উল্লেখ আছে। তিনি সরকার দলীয় এমপিদের উদ্দেশে বলেন, এটাকে আমাদের দলীয় বক্তব্য হিসেবে নেবেন না। এটা জাতীয় স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়।
দরপত্র আহ্বানে দেশের স্বার্থবিরোধী কোন ঘটনা ঘটেনি: তোফায়েল
পয়েন্ট অব অর্ডারে দেয়া ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের বক্তব্যের জবাবে আওয়ামী লীগের সিনিয়র পার্লামেন্টারিয়ান তোফায়েল আহমদ বলেন, ব্যারিস্টার মওদুদ একজন বিজ্ঞ আইনজীবী। তিনি ভাল আইন জানেন। কিন্তু তিনি যা বলেছেন, তা পয়েন্ট অব অর্ডারে হয় না। তিনি দুঃখপ্রকাশ করে বলেন, দুর্ভাগ্য যে বিরোধীদলীয় নেতা দীর্ঘদিন পর সংসদে এলেন, দেখলেন এবং চলে গেলেন। আমরা সংখ্যার বিচার করতে চাই না। আমরা পরস্পরের কথা শুনবো। তোফায়েল বলেন, ব্যারিস্টার মওদুদ ও আমি দুইজনই শিল্পমন্ত্রী ছিলাম। তিনি বিনিয়োগ ভাল বোঝেন। তিনি নিশ্চয় বাজেট অধিবেশনে বলবেন, দেশে এখন বিনিয়োগ নেই। তোফায়েল আহমেদ বলেন, ভারত সরকার নয়, ভারতীয় একটি বেসরকারি কোম্পানি নারায়ণগঞ্জে কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণ করা যাবে কিনা এ বিষয়ে স্টাডি করছে। আমাদের সরকার তাদের স্টাডির অনুমতি দিয়েছে। বিষয়টি নিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভারতীয় হাইকমিশনের সঙ্গে কথা বলেছেন। এটার সঙ্গে ভারত সরকারের কোন সম্পর্ক নেই। আজ যদি চট্টগ্রাম গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণে চীন স্টাডি করতো তাহলে আপনারা কিছুই বলতেন না। ভারত করছে এ জন্য আপনারা সমালোচনা করছেন। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী দেশের স্বার্থ সমুন্নত রেখে ভারতের সঙ্গে বুদ্ধিদীপ্ত চুক্তি করেছেন। বিরোধী দলীয় নেতা যখন ভারত সফরে গিয়েছিলেন তখন ভারত সরকারের আতিথেয়তায় তিনিও খুশি হয়েছিলেন।
দ্বিতীয় দফা ওয়াকআউট
৩০০ বিধিতে দেয়া স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যের পর পয়েন্ট অব অর্ডারে বক্তব্য দেয়ার জন্য দাঁড়ান বিএনপি দলীয় এমপি সৈয়দা আশিফা আশরাফি পাপিয়া। কিন্তু বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান প্রসঙ্গে গণমাধ্যমে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. দীপুমনির দেয়া বক্তব্যের ব্যাপারে কথা বলতে গেলে জোরালো প্রতিবাদ করেন সরকারদলীয় এমপিরা। এ পর্যায়ে স্পিকার তার মাইক বন্ধ করে দিলে প্রতিবাদে দ্বিতীয় দফা ওয়াকআউট করে বিরোধী দল।
কায়কোবাদ এমপির ৯০ কার্যদিবস ছুটি মঞ্জুর
বিএনপি দলীয় এমপি বিদেশে চিকিৎসাধীন শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদের ৯০ কার্যদিবস ছুটি মঞ্জুর করেছেন স্পিকার। কায়কোবাদের আবেদনের প্রেক্ষিতে অতীতের রীতি অনুযায়ী এ ছুটি মঞ্জুর করেন তিনি।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য প্রত্যাখ্যান বিএনপির
সংসদ থেকে দ্বিতীয় দফা ওয়াকআউটের পর বিএনপির সিনিয়র এমপি ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ সংসদের মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ ব্রিফিং করেন। রাজধানীতে সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নির্দেশ প্রসঙ্গে গতকাল সংসদে ৩০০ বিধিতে একটি ব্যাখ্যা দেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী । ব্যারিস্টার মওদুদ বলেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ৩০০ বিধিতে দেয়া বক্তব্য আমরা প্রত্যাখ্যান করছি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আজ বাজেট ঘোষণার দিন সংসদে যোগ দেবে না বিএনপি।