পুলিশ ও স্থানীয় সূত্র জানায়, গাজীপুর জেলা সদরের ভোগড়া চৌধুরী বাড়ি রোড়ে অবস্থিত লাবীব গ্রুপের স্টার লাইট সোয়েটার্স লিমিটেড কারখানার শ্রমিকরা গতকাল বুধবার সকালে কাজে যোগ দেয়। প্রচণ্ড গরম থাকায় সকালে শ্রমিকরা পর্যায়ক্রমে কারখানার সরবরাহ লাইনের পানি পান করে। পরে সকাল সাড়ে নয়টার দিকে একে একে শ্রমিকরা অসুস্থ হয়ে পড়তে থাকে। তাদের মধ্যে কারো বমি, গলা জ্বালাপোড়া, বুকে, পেটে ও মাথায় ব্যথা এবং পেটেরপীড়া দেখা দেয়। বিষয়টি কারখানা কর্তৃপক্ষকে জানালে তাত্ক্ষণিকভাবে কারখানার সিনিয়র নির্বাহী পরিচালক মো. শফিকুল ইসলাম বিভিন্ন ফ্লোরে স্থাপিত মাইকযোগে কারখানার সরবরাহ লাইনের পানি পান না করার জন্য শ্রমিক কর্মচারীদের সতর্ক করে দেন। পর্যায়ক্রমে শত শত শ্রমিক অসুস্থ হয়ে পড়তে থাকলে কারখানা কর্তৃপক্ষ হতবাক হয়ে যায়। অসুস্থ শ্রমিকদের রিকশা, ভ্যান, টেক্সি, বাস, ট্রাকসহ বিভিন্ন পরিবহনে করে গাজীপুর সদর হাসপাতাল, টঙ্গী সরকারি হাসপাতাল, উত্তরার বাংলাদেশ মেডিক্যাল কলেজ, বোর্ড বাজারে সুলতান হাসপাতাল ও কুনিয়া তায়রুন্নেসা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালসহ বিভিন্ন ক্লিনিক ও স্বাস্থ্য কেন্দ্রে পাঠানো হয়। হাসপাতালগুলোতে রোগীদের স্যালাইনসহ প্রাথমিক চিকিত্সা দেয়া হয়।
কারখানার লিংকিং অপারেটর এনামুল জানায়, ১০ তলা ভবনের প্রথম থেকে আট তলা পর্যন্ত প্রতিটি ফ্লোরেই শ্রমিকরা কাজ করছিল। পানি পানের পর বিভিন্ন ফ্লোরে শ্রমিকরা অসুস্থ হয়ে পড়তে থাকে। তাদের উদ্ধার করে বিভিন্ন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। অসুস্থদের মধ্যে গাজীপুর সদর হাসপাতালে চিকিত্সাধীন রয়েছে সুইং হেলপার রেহেনা (৩০), মেকানিক টেকনিশিয়ান আ. আজিজ (২৬), নার্স সাথী (২৬), পিকিউসি রেহেনা (২৫), ওয়াসিং এর তারা মিয়া (৪৫), সুইং সেকসনের ববিতা (৩২), আ. কাদের (২৬), পিকিউসি আনোয়ারা খাতুন (৩০), আনিকা (২৪), বেলাল (২৬), বুলবুলি (৪০), রুকশানা (২০), রুপিয়া (২২), শাপলা (২৭), বুলবুলি (২৩), আতিকুর (২৫), বাবুল (৩৪), কাদের (১৮), ছাইদুল (২৫), বায়জি (২০) প্রমুখ।
গাজীপুর সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিত্সক তপন কান্তি সরকার জানান, হাসপাতালে আসা অনেক রোগী ঘন ঘন বমি করে নিস্তেজ হয়ে পড়ে। তাদেরকে স্যালাইন দিয়ে রাখার কিছুক্ষণ পর অনেকে কিছুটা সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে যান।
পানি পানে গণহারে শ্রমিক অসুস্থ হওয়ার খবর পেয়ে আশপাশের বিভিন্ন পোশাক কারখানায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে কর্তৃপক্ষ গতকালের জন্য সেসব কারখানায় ছুটি ঘোষণা করে। এ সময় বিভিন্ন কারখানার শ্রমিক ও এলাকার উত্সুক মানুষ ঘটনাস্থলে এসে ভিড় জমায়। অনেকে তাদের অসুস্থ স্বজনকে খুঁজতে কারখানা ও হাসপাতালে ছোটাছুটি করতে থাকে। পানি খেয়ে শ্রমিক অসুস্থ হয়ে যাওয়ার ঘটনায় ওই এলাকায় শ্রমিকদের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দেয়। তারা স্টার লাইট কারখানার কয়েকটি কাচ ভাঙচুর করে। পরে কলাপসিবল গেট ভেঙ্গে বহিরাগত শ্রমিকরা ভিতরে ঢোকার চেষ্টা করলে পুলিশ তাদের সেখান থেকে সরিয়ে দেয়।
গাজীপুরের জেলা প্রশাসক মো. নূরুল ইসলাম, পুলিশ সুপার মো. আব্দুল বাতেন সংশ্লিষ্ট কারখানা পরিদর্শন করেন। গতকাল দুপুরে গাজীপুর সদর হাসপাতালে চিকিত্সাধীন শ্রমিকদের দেখতে যান স্থানীয় সংসদ সদস্য জাহিদ আহসান রাসেল।
জানা গেছে, স্টার লাইট সোয়েটার্স লিমিটেড কারখানায় প্রায় সাড়ে ছয় হাজার শ্রমিক কাজ করছিল। কারখানার তিন রিজার্ভ ট্যাংকের একটি থেকে আসা পানি যে সকল শ্রমিক পান করেছে তারাই কেবল অসুস্থ হয়েছে। উদ্ধারকারী শ্রমিকরা জানায়, পানি পান করে অসুস্থ হয়ে যাওয়া শ্রমিক পাঁচশ’র বেশি।
কারখানার কর্মকর্তা মাহতাব উদ্দিন জানান, কারখানার তিন রিজার্ভ ট্যাংকের একটির পানিতে দুর্গন্ধ এবং সাদা ফেনার মত দেখতে পাওয়া গেছে। বিষয়গুলো পুলিশকে জানানো হয়েছে।
গাজীপুরের সিভিল সার্জন ডাঃ সৈয়দ হাবিবুল্লাহ জানান, কারখানার পানি খেয়েই শ্রমিকরা অসুস্থ হয়েছেন বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। বিষয়টি খতিয়ে দেখতে ডা. জাহাঙ্গীর হোসেনের নেতৃত্বে একটি তদন্ত দলকে কারখানায় পাঠানো হয়েছে।
এদিকে আইইডিসিআর-এর পরিচালক অধ্যাপক মাহমুদুর রহমান গতকাল রাতে ইত্তেফাককে জানিয়েছেন, তাদের পাঠানো বিশেষজ্ঞ দল ইতিমধ্যে ঘটনাস্থল থেকে পানির নমুনা সংগ্রহ করেছেন। তারা বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিত্সাধীন রোগীদের সঙ্গে কথা বলেছেন। আজ বৃহস্পতিবার পানি পরীক্ষার ফলাফল জানা যেতে পারে।
কারখানার সিনিয়র নির্বাহী পরিচালক মো. শফিকুল ইসলাম জানান, অসুস্থ শ্রমিকদের চিকিত্সার ব্যাপারে খোঁজ-খবর নেয়া হচ্ছে। তাদের সুস্থ করে তুলতে সব রকম ব্যবস্থা নেয়া হবে।