ঢাকা-ওয়াশিংটন সমঝোতা সই, সহিংসতা থেকে বেরিয়ে আসার তাগিদ শেরম্যানের

ঢাকা-ওয়াশিংটন সমঝোতা সই, সহিংসতা থেকে বেরিয়ে আসার তাগিদ শেরম্যানের

হরতালের সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসার তাগিদ দিয়েছেন সফররত মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের রাজনীতি বিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি ওয়েনডি শেরম্যান। হরতাল ও মিছিলের কারণে ঢাকার রাস্তাঘাট বন্ধ থাকারও সমালোচনা করেছেন তিনি। বলেছেন, নির্বাচনী বছরে সহিংসতার
পুরনো চক্র থেকে জাতিকে বের করে আনতে হবে। এর জন্য রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও জনগণকে এক সঙ্গে কাজ করতে হবে। সফরের দ্বিতীয় ও শেষ দিনে দু’দফায় মিডিয়ার মুখোমুখি এবং এক সেমিনারে তিনি এসব কথা বলেন। ঢাকা-ওয়াশিংটন দ্বিতীয় অংশীদারিত্ব সংলাপে নেতৃত্ব দিয়ে দু’দিনের সফরে ঢাকায় আসা আন্ডার সেক্রেটারি প্রথম দিনেই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে বসেন। গতকাল দিনের শুরুতে সরকারি কর্মকর্তা, শ্রমিক নেতা, মালিক ও ক্রেতা প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে একটি গোলটেবিল আলোচনায় বক্তৃতা করেন। পরে রোববার থেকে শুরু হওয়া দ্বিতীয় অংশীদারিত্ব সংলাপের প্লিনারি সেশনে যোগ দেন। সংলাপ শেষে বাংলাদেশ দলের নেতা পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হকের সঙ্গে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন ‘মেঘনা’য় যৌথ সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত হন। এর আগে ঢাকা-ওয়াশিংটন চলমান সন্ত্রাস দমন বিষয়ক সহযোগিতার কার্যক্রম আরও জোরদার করতে একটি সমঝোতা স্মারক সই করা হয়। সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে ওয়েনডি শেরম্যান বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। বলেন, আসন্ন নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। নির্বাচনকে অবশ্যই অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করতে হবে। নির্বাচনকালীন সরকার পদ্ধতির বিষয়েও আলোচনার মাধ্যমে দ্রুত সমঝোতায় পৌঁছার পরামর্শ দেন তিনি। ওবামা প্রশাসনের বৈদেশিক সম্পর্ক বিষয়ক তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ এ নেতা বাংলাদেশের শ্রমমান ও শ্রমিকদের জীবন-মান উন্নয়নের তাগিদ দেন। সাভারের রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় গভীর শোক ও উদ্বেগ প্রকাশ করে এমন ‘ট্র্যাজেডি’ ভবিষ্যতে যাতে আর না ঘটে, সে জন্য এখনই কার্যকর ব্যবস্থা নিতে সরকার ও সংশ্লিষ্টদের প্রতি অনুরোধ জানান। পরে হোটেল রূপসী বাংলায় এক সেমিনার বক্তৃতায় তিনি উদভূত পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের বাংলাদেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে না নেয়ার আহ্বান জানান। ‘সংস্কার’-এর মধ্যেই সমাধান নিহিত, বিনিয়োগ গুটিয়ে নেয়া কোন সমাধান নয় বলেও মন্তব্য করেন মার্কিন কূটনীতিক। গণমাধ্যমের সঙ্গে আলোচনায় মানবতা বিরোধী অপরাধের বিচার, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, সভা-সমাবেশসহ প্রতিবাদী কর্মসূচির ওপর সরকারি নিষেধাজ্ঞা, খুন, গুমসহ মানবাধিকার লঙ্ঘন ইত্যাদি বিষয়ে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন। এ সময় এক প্রশ্নের জবাবে শেরম্যান বলেন, রোববার তার আগমনের দিনে হরতাল হওয়ায় পূর্বনির্ধারিত সিডিউলে অনেক পরিবর্তন আনতে হয়েছে। সময়সূচি মিলাতে না পেরে খোদ বিরোধী দলের নেতার সঙ্গে বৈঠকটি বাতিল করতে হয়েছে।
নির্বাচন নিয়ে আশাবাদী শেরম্যান: পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনির সঙ্গে বৈঠক করে ওয়েনডি শেরম্যান বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন নিয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করেন। একই সঙ্গে ওই নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার তাগিদও দেন তিনি। গতকালের সংবাদ সম্মেলনের উদ্বোধনী বক্তৃতায়ও নির্বাচন নিয়ে তার প্রত্যাশার কথা পুনর্ব্যক্ত করেন। প্রশ্নোত্তরপর্বে এক সিনিয়র সাংবাদিক দেশের চলমান সংঘাতময় রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে সমঝোতার ন্যূনতম কোন আলামত না থাকার বিষয়গুলো তুলে ধরে ওয়েনডি শেরম্যানের কাছে তার ‘আশাবাদী’ হওয়ার কারণ জানতে চান। জবাবে শেরম্যান বলেন, বাংলাদেশের গণতন্ত্র যতবারই বাধাগ্রস্ত হয়েছে, ততবারই দেশের জনগণ তা সঠিক পথে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছে এবং তা এগিয়ে নিয়েছে। সংঘাতময় রাজনীতি থেকে জনগণই বের হওয়ার পথ খুঁজে নিতে সক্ষম হবে এমন প্রত্যাশা ব্যক্ত করে তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা এগিয়ে চলছে। আমরা আশা করি, বাংলাদেশও সেদিকে এগিয়ে যাবে। বর্তমান সঙ্কট উত্তরণে তার দেশের বিশেষ কোন পরামর্শ নেই জানিয়ে তিনি বলেন, এ দেশের জনগণ যে সিদ্ধান্ত নেবে তাতে তাদের সমর্থন ও সহযোগিতা থাকবে। রানা প্লাজা ধস প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ঘটনাটি খুবই দুঃখজনক। এ ঘটনায় আহত-নিহত সবার পরিবারের পাশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আছে। মানবিকতার দিক থেকে তাদের সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসবে। বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনা এব্যাপারে আন্তরিকভাবে কাজ করছেন বলেও উল্লেখ করেন তিনি। জিএসপি সুবিধা প্রসঙ্গে শেরম্যান বলেন, আগামী জুনে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত পাওয়া যাবে। এর আগে জিএসপি নিয়ে তেমন কিছুই বলার নেই। ওই প্রক্রিয়া স্বাভাবিক গতিতেই এগোচ্ছে বলেও জানান তিনি। টিকফা চুক্তি প্রসঙ্গে শেরম্যান বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশ এ বিষয়ে আন্তরিক। এর মাধ্যমে দু’দেশের ব্যবসায়িক সম্পর্ক আরও সুদৃঢ় হবে। তবে এ ক্ষেত্রে টিকফাই একমাত্র ব্যবস্থা নয় মন্তব্য করে তিনি বলেন, অন্য অনেক পন্থা রয়েছে, যার মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে এগিয়ে নেয়া যায়। চলমান মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান জানতে চাইলে জবাব না দিয়ে আন্ডার সেক্রেটারি ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনার কাছে মাইক্রোফোন তুলে দেন। এ সময় রাষ্ট্রদূত বিচার প্রক্রিয়াকে স্বচ্ছ ও বিশ্বাসযোগ্য হওয়ার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। সংবাদ সম্মেলনে অংশীদারিত্ব সংলাপের বিস্তারিত জানিয়ে যৌথ ঘোষণা পাঠ করা হয়। এ সময় উভয় দেশের সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
সংস্কারেই সমাধান, প্রত্যাহারে নয়: বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ (বিআইআইএসএস) আয়োজিত সেমিনারে সাভারে রানা প্লাজা ধসের পর বিদেশী বিনিয়োগ প্রত্যাহার প্রসঙ্গে ওয়েনডি শেরম্যান বলেছেন, এ ট্র্যাজেডি থেকে শিক্ষা নিতে হবে। পুরো শিল্পে ব্যাপক সংস্কার আনতে হবে। সংস্কারই সমাধান। বিনিয়োগ প্রত্যাহারে কোন সমাধান আসবে না। তবে এসব ঘটনা যাতে আর না ঘটে এ জন্য সংশ্লিষ্টদের আরও তৎপর হতে হবে। সরকার, সুশীল সমাজ ও সাধারণ নাগরিকদের এগিয়ে আসতে হবে। হোটেল রূপসী বাংলায় ‘সীমাহীন অংশীদারিত্ব: যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ সম্পর্ক’ শীর্ষক ওই সেমিনারে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনা, বিআইআইএসএস’র চেয়ারম্যান মুন্সি মনিরুজ্জামান ও পররাষ্ট্র সচিব শহিদুল হক বক্তৃতা করেন। আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীরা যাতে বাংলাদেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে না নেয় এ জন্য শেরম্যান নিজে কাজ করছেন জানিয়ে বলেন, বাংলাদেশে যাতে নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা যায় তার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসায়ীদের অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা চলছে। এ দেশ যাতে নিজের আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও বাণিজ্যের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠতে পারে এ জন্য সহযোগিতা দেয়া হচ্ছে। রাষ্ট্রদূত মজিনাও ক্লান্তিহীন কাজ করে চলেছেন। এই প্রচেষ্টায় আমেরিকান জনগণও বাংলাদেশের অংশীদার। পথে বাধা থাকবে, তবে অতীত বলে দেয় বাংলাদেশীরা শুধু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতেই নয় বরং সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য কঠিন সিদ্ধান্তগুলো নিতে পারে।
শ্রম মান: দেশের শ্রম মান বিষয়ে শেরম্যান বলেন, উপযুক্ত শ্রম মান প্রণয়ন করার দায়িত্ব বাংলাদেশের সরকারের। যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশী প্রবাসী প্রকৌশলী ও স্থাপত্যবিদরা মিলে একটি স্বাধীন নিরাপত্তা পর্যবেক্ষণ দল গঠনের সহায়তার লক্ষ্যে উদ্যোগ নিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রও স্থানীয় শ্রম ও সুশীল সমাজ প্রতিষ্ঠানগুলোকে অর্থায়ন করছে যাতে শ্রম ইউনিয়নে যোগদানের স্বাধীনতাসহ কর্মস্থলে প্রাথমিক অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধার প্রসার করা যায়। তবে সহিংসতা তাদের ‘দুশ্চিন্তা’য় ফেলে জানিয়ে তিনি বলেন, এটা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকেও পিছিয়ে দেয়। এ রকম পরিবেশ রাষ্ট্রের নাগরিকদের কিছু অংশকে চরমপন্থি করে তোলে, পাশাপাশি সংখ্যালঘুদের মধ্যে ভয়ের সৃষ্টি করে। বাংলাদেশের অগ্রযাত্রায় যুক্তরাষ্ট্র উৎসাহী হয় উল্লেখ করে শেরম্যান বলেন, যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ সংলাপের মাধ্যমে অংশিদারীত্বের শেকড় প্রথিত হয়েছে। দু’দেশের মধ্যে বৈঠকে একটি বেসরকারি ফোরাম যোগ হয়েছে। যা অংশীদারিত্ব সংলাপে ভিন্ন মাত্র যোগ করেছে। দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যিক সম্পর্ক উন্নয়ন এবং বাংলাদেশে কিভাবে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা যায় ওই ফেরাম সেই সুপারিশ তুলে ধরবে বলেও জানান তিনি।
ব্র্যাক ও গ্রামীণ ব্যাংক: ব্র্যাক এবং গ্রামীণ ব্যাংক বাংলাদেশের এ দু’প্রতিষ্ঠান দারিদ্র্য ও দুর্ভোগের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বিশ্বে আদর্শ হিসেবে কাজ করছে। প্রতিষ্ঠান দু’টি দেশে দরিদ্র জনগণের ক্ষমতায়ন এবং অভাবীদের সহযোগিতা করার লক্ষ্য নিয়ে তাদের কাজ শুরু করেছিল। বর্তমানে কাজ করছে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে, বিশ্বের কিছু দুস্থ এলাকায়। এ দেশের যা কিছু ভাল তার সব কিছু ব্র্যাক এবং গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিনিধিত্ব করে বলেও উল্লেখ করেন তিনি। আগের সফরে তিনি গ্রামীণ ব্যাংকের কিছু কার্যক্রম তার সচক্ষে দেখার সুযোগ হয়েছিল জানিয়ে ওয়েনডি বলেন, আমরা চাই গ্রামীণের অখণ্ডতা ও কার্যকারিতা অব্যাহত থাকুক। আর গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা প্রফেসর ড. মুহম্মদ ইউনূস কোন দেশের প্রথম মুসলিম নাগরিক যিনি এই কংগ্রেশনাল স্বর্ণপদক লাভ করেছেন, যা কি না কোন বেসামরিক নাগরিকের জন্য যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেসের সর্বোচ্চ সম্মাননা। অনুষ্ঠানে মজিনা বলেন, বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক খুবই ভাল। আমরা বর্তমানে সংলাপের দিকেই বেশি জোর দিয়েছি।
শেরম্যানকে শেখ হাসিনা: সিটি করপোরেশনের মতো জাতীয় নির্বাচনেও বিরোধী দল অংশ নেবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ঢাকা সফরে আসা মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের রাজনীতি বিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি ওয়েন্ডি শেরম্যান তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেলে তিনি এ আশাবাদ ব্যক্ত করেন। প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব বিজন লাল দেব বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান। গণভবনে বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়। বিজন লাল দেব জানান, শেখ হাসিনা বলেছেন, আগামী সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে ওয়েস্টমিনস্টার পদ্ধতিতে, যা সারা বিশ্বে সংসদীয় গণতন্ত্রের অনুকরণীয় হিসেবে পরিচিত। প্রধানমন্ত্রী আশা করেন, ওই পদ্ধতিতে বিরোধী দলও নির্বাচনে আসবে। অ্যাম্বাসেডর এট-লাজ এম জিয়াউদ্দিন ও ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনা বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।

অন্যান্য আন্তর্জাতিক বাংলাদেশ শীর্ষ খবর