নালিতাবাড়ীতে নতুন জাতের এক ধান আবিষ্কার করে বিস্ময় সৃষ্টি করলেন কৃষক মোকছেদুর রহমান লেবু। নতুন জাতের এই ধানে এবার ফলন এসেছে একর প্রতি ১২০ মণ (শুকানোর পর)। এই ফলনে বিএডিসি কর্তৃপক্ষ আশা
প্রকাশ করে বলছে, নতুন এই ধানবীজ সারাদেশে ছড়িয়ে দিতে পারলে খাদ্য উত্পাদনে রের্কড সৃষ্টি করা যাবে। আউশ, আমন, বোরো—তিন মৌসুমেই এই ধান আবাদযোগ্য। নালিতাবাড়ীর বাইরে নকলা ও ময়মনসিংহের মধুপুরেও এবার ধানটির আবাদ হয়েছে। যেভাবে আবিষ্কার
বছরখানেক আগের কথা। নালিতাবাড়ীর কৃষক মোকছেদুর রহমান লেবু (৪৫) বিএডিসি থেকে নেরিকা-১০ জাতের ২০ কেজি বীজধান সংগ্রহ করে আমন বীজতলা তৈরি করেন। সেই চারা তিনি রোপণ করেন এক একর জমিতে। ধানের শীষ আসার পর লেবু লক্ষ্য করেন পুরো ক্ষেতের কোথাও কোথাও ধান গাছ অপেক্ষাকৃত উঁচু। বিশেষ কৌতূহলের কারণে অপেক্ষাকৃত উঁচু ধানগাছগুলোকে বিশেষ পাহারা রাখা হয়। তারপর যখন ধান কাটার সময় আসে তখন ওই ব্যতিক্রমী গাছগুলোর ধান (মাত্র চার কেজি) আলাদাভাবে সংগ্রহ করেন লেবু। পরবর্তী সময়ে এই চার কেজি ধান শুকিয়ে তা দিয়ে আউশের বীজতলা তৈরি করেন তিনি। পরে লেবু প্রায় তিন বিঘা জমিতে সেই চারা রোপণ করেন। আবাদ শেষে ফলন পান ৫৭ মণ ধান।
এগিয়ে আসে বিএডিসি
যে বিএডিসি কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে মূল নেরিকা ধান সংগ্রহ করেছিলেন লেবু, সেই বিএডিসি কর্তৃপক্ষই বিশেষভাবে বাছাইকৃত ধানের আশাতীত ফলনের খবরে আগ্রহী হয়ে ওঠে তা সংগ্রহ ও বাজারজাত করার ব্যাপারে। তারা ৫৭ মণ ধান লেবুর কাছ থেকে ৩১ টাকা কেজি হিসাবে কিনে তাদের মধুপুর খামারে নিয়ে রোপণ করে। পরবর্তী সময়ে সেখান থেকে বীজ এনে নালিতাবাড়ীর ৯৫ জন চাষী ৩০০ বিঘা জমিতে রোপণ করে। এবার জমির উত্পাদিত ধান থেকে ২০০ টন বীজ হিসাবে কিনে নেবে (প্রতি কেজি ৩১ টাকা হিসাবে) বলে জানিয়েছে বিএডিসি। একদিকে বাম্পার ফলন আর অন্যদিকে উচ্চ মূল্য পেয়ে ৯৫ কৃষক বেজায় খুশী।
নাম নিয়ে গবেষণা চলছে
বিএডিসির সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, প্রাকৃতিকভাবে আবিষ্কৃত বিশেষ জাতের নতুন ধানের আপাতত নাম রাখা হয়েছে ‘নেরিকা মিউট্যান্ট’। স্থানীয়রা বলছেন, এই ধান আল্লাহর বিশেষ নিয়ামত। তাদের দাবি, এই ধানের নাম রাখা হোক ‘নিয়ামত ধান’।
এ বিষয়ে নালিতাবাড়ী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কৃষক মোকছেদুর রহমান লেবু বলেন, ‘মতিয়া আপার (স্থানীয় সংসদ সদস্য কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী) পরামর্শে নতুন জাতের ধান এলাকায় ছড়িয়ে দিতে কাজ করেছি। কৃষকদের উন্নয়নের কথা ভেবে ‘নেরিকা মিউট্যান্ট ধান সংরক্ষণ ও রোপণ’ নামে একটি সমিতিও গঠন করেছি। সমিতির মাধ্যমে নালিতাবাড়ী উপজেলায় এবার ৯৫ জন কৃষক প্রায় তিনশ’ বিঘা জমিতে নেরিকা মিউট্যান্ট ধানের আবাদ করেছে। সবাই বস্পার ফলনও পেয়েছে।’ তিনি জানান, তিনি নিজেই এবার আবাদ করেছেন প্রায় ৪৯ বিঘা জমিতে।
এলাকায় ব্যাপক সাড়া জাগানো এই ধান কাটা উপলক্ষে সম্প্রতি আয়োজিত অনুষ্ঠানে আসেন কৃষি সমপ্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ সুভাষ চন্দ্র দেবনাথসহ কৃষি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাবৃন্দ। তারা জানান, আমাদের দেশে অনেক উচ্চ ফলনশীল ধান আছে। তবে সেগুলির আবাদকাল (অর্থাত্ বীজ থেকে ধান হতে) অনেক দীর্ঘ। কিন্তু এই নেরিকা মিউট্যান্ট ধানে অল্প সময়ে ফলন আসে। আউশ, বোরো ও আমন—তিন মৌসুমেই আবাদের সফলতা আছে। আমন মৌসুমে আবাদ আসতে সময় লাগে ১১০ থেকে ১২০ দিন। আর আউশে সময় লাগে ৯০ দিন। এই নতুন ধান দেশের আবহাওয়া উপযোগী হওয়ায় ফলন বেশি হয়। ধানগাছ বাতাসে হেলে পড়ে না। শিকড় অনেক গভীরে যায়।
উল্লেখ্য, কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী কয়েক বছর আগে আফ্রিকার উগান্ডা থেকে মাত্র ৬০ গ্রাম নেরিকা জাতের ধান বীজ এনে বিএডিসি কর্তৃপক্ষের কাছে দিয়েছিলেন। বিএডিসি প্রথমে নেরিকা ধানের উপযোগিতা ও উত্পাদন কৌশল যাচাই-বাছাই করে তাদের তিনটি খামারে বপণ করেন। এর সফলতা আসে। পরবর্তী সময়ে চাষীদের মাঝে নেরিকা ধান বীজ পরীক্ষামূলকভাবে আবাদের জন্য বিতরণ করা হয়। পাশা-পাশি বিএডিসির খামারেও তিন মৌসুমেই নেরিকা আবাদ করা হয়। এরপর নেরিকা ধান ছড়িয়ে দেয়া হয় সারা দেশে।