সাভারের রানা প্লাজায় গার্মেন্ট শ্রমিকদের মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনায় দায়ীদের বিচার দাবি এবং শোক দিবসে কারখানা খোলার প্রতিবাদে গতকাল রাজধানীসহ আশপাশের শিল্প এলাকায় বিক্ষোভ ও ভাঙচুর করেছেন পোশাক শ্রমিকরা। বিক্ষোভকালে বিভিন্ন স্থানে পুলিশের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষও হয়েছে। বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা রাস্তা অবরোধ করে যানবাহনে ভাঙচুর করেন। পরিস্থিতি অবনতি হওয়ার আশঙ্কায় গতকাল ঢাকা, সাভার, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জের গার্মেন্টগুলোতে ছুটি ঘোষণা করা হয়।
দুপুরে শ্রমিকরা বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন রাজধানীর হাতিরঝিলে বিজিএমইএ ভবনের সামনে। বিক্ষোভের সময় বিজিএমইএ অফিসের সামনের একটি প্রাইভেটকার ভাঙচুরের সময় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ হয় শ্রমিকদের। ওই সময় পুলিশের লাঠিচার্জে আহত হয় দু’জন শ্রমিক। সকাল থেকে ফার্মগেট, রামপুরা, মালিবাগসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে শ্রমিকরা গার্মেন্ট বন্ধ রেখে প্রতিবাদ জানাতে যান বিজিএমইএ অফিসের সামনে। সকাল ১১টার দিকে বিজিএমইএ অফিসের সামনে জড়ো হয়ে শ্রমিকরা ভবনের ভেতরে প্রবেশের চেষ্টা চালান। পুলিশ বাধা দিলে বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা বিজিএমই ভবনের দিকে ইটপাটকেল ছুড়তে থাকেন। ওই সময় কাওরান বাজারে একটি মার্কেটে ভাঙচুর করেন শ্রমিকরা।
রানা প্লাজা ধসে শ্রমিক নিহত হওয়ার ঘটনায়, ভবন মালিকের বিচার ও গার্মেন্ট ছুটি দেয়ার দাবিতে গতকাল সকাল থেকেই বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন গাজীপুরের গার্মেন্ট শ্রমিকরা। তারা কর্মবিরতিতে নেমে হাজার হাজার শ্রমিক লাঠিসোটা নিয়ে বিভিন্ন সড়কে বিক্ষোভ করতে থাকেন। পরে চান্দনা চৌরাস্তায় ঢাকা-ময়মনসিংহ ও ঢাকা টাঙ্গাইল মহাসড়ক অবরোধ করে। ভাঙচুর হয় অনেক কারখানা। ছুটি না দেয়ায় গাজীপুর ও টঙ্গীর অনেক কারখানাও ভাঙচুর করা হয়। এ সময় আড়ং প্যাকেজিং কারখানায় এবং একটি মোটর সাইকেলে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয় । ওদিকে টঙ্গীর পিণানী গার্মেন্ট কারখানার ভেতরে থাকা কয়েকটি মোটরসাইকেল, কাভার্ড ভ্যান ও প্রাইভেটকারে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। ঘটনার সময় একজন শ্রমিককে ধরে নেয়ার গুজবে গাজীপুরের পরিবহন মালিক ও শ্রমিক সমিতির অফিস এবং পাশের মার্কেটে হামলা চালিয়ে ব্যাপক ভাঙচুর করা হয়। ইটপাটকেলসহ নানাভাবে বিভিন্ন স্থানে প্রায় অর্ধশত লোকজন আহত হয়। এদিকে তাণ্ডব চালানোর সময় টেকনগপাড়া এলাকার কার্লোস ফ্যাশন কারখানায় ভাঙচুরের পর হামলা চালিয়ে ব্যাপক লুটপাট করা হয়েছে। কারখানা ম্যানেজার মো. কাওসার জানান, দুষ্কৃতকারীরা হামলা চালিয়ে মেশিনপত্র ও কারখানা ব্যাপক ভাঙচুরের পর রপ্তানির উদ্দেশ্যে প্যাকিং করে রাখা প্রায় ৪০ লাখ টাকা দামের তৈরী পোশাক দু’টি পিকআপে তুলে নিয়ে গেছে।
পরিস্থিতি সামাল দিতে মহানগরের সব গার্মেন্ট কারখানায় বৃহস্পতিবারের মতো ছুটি ঘোষণা করা হয়।
অন্যদিকে গাজীপুর পরিবহন মালিক সমিতি, শ্রমিক ইউনিয়ন অফিস ও যানবাহন আগুন ও ভাঙচুরের প্রতিবাদে এবং এর সঙ্গে জড়িতদের বিচারের দাবিতে দুপুর থেকে মালিক-শ্রমিকরা গাজীপুর হয়ে উত্তরাঞ্চলীয় ১৩ জেলার ৪০ রুটের বাস চলাচল বন্ধ করে দেয়। গাজীপুর মহানগরের ভোগড়া, নাওজোড়, তিনমড়ক সকাল ৮টায় শ্রমিকরা তাদের কারখানায় ঢুকেই শোক দিবসের ছুটি দাবি করে। মুহূর্তেই তারা লাঠিসোটা নিয়ে সড়ক দখল করে নেয়। তারা অন্য কারখানার শ্রমিকদের বের করে আনে। সকাল সাড়ে ৮টার দিকে সদর উপজেলার নাওজোর এলাকার দিগন্ত সোয়েটার, ভোগড়া এলাকার স্টার লাইট সোয়েটার, নেকসাস সোয়েটার, গরিব অ্যান্ড গরিব সোয়েটার ও মাইশা-মনিশা পোশাক কারখানাসহ বিভিন্ন কারখানার কয়েক হাজার শ্রমিক কাজে যোগ না দিয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোকজন হাজার হাজার শ্রমিকের মারমুখি অবস্থা দেখে অনেকটা নিরুপায় হয়ে যায়। এক পর্যায়ে মহানগরের লক্ষ্মীপুরা এলাকায় ঢাকা-গাজীপুর সড়কের পাশের আড়ং ফ্যাক্টরিতে ভাঙচুর করে আগুন ধরিয়ে দেয়। এছাড়া টঙ্গী ও গাজীপুরের বিভিন্ন স্থানে বেশ কিছু যানবাহনে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়।
বিশৃঙ্খলা এড়াতে গাজীপুর মহানগরীর ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের চান্দনা চৌরাস্তা, ভোগড়া চৌরাস্তা ও ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের কোনাবাড়ী শিল্পাঞ্চল এবং টঙ্গীর বিভিন্ন এলাকার সব পোশাক কারখানায় ছুটি ঘোষণা করেছে কর্তৃপক্ষ।
কারখানার আগুন নিয়ন্ত্রণের জন্য ঘটনাস্থলে ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশের গাড়ি এলে তাদের গাড়িও ভাঙচুর চালায় শ্রমিকরা। অন্যদিকে, একই ঘটনায় বিুব্ধ শ্রমিকরা গাজীপুরের ভোগরা চৌরাস্তা, চান্দনা চৌরাস্তা ও কোনাবাড়ীতে লাঠিসোটা নিয়ে বিভিন্ন কারখানা ভাঙচুর চালিয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে। টঙ্গীর গাজীপুরা, বড়বাড়ী, মিলগেট, মেঘনা রোড, গাজীপুরের চান্দনা, ভোগড়া, নাওজোর, তিন সড়ক, কোনাবাড়ী, রাজেন্দ্রপুর, শ্রীপুরের মাস্টারবাড়ীসহ বিস্তীর্ণ এলাকায় তাদের তাণ্ডব ছড়িয়ে যায়। চার ঘণ্টার জন্য সড়ক মহাসড়ক অচল হয়ে যায়। এ সময় অনেক স্থানে বিচ্ছিন্নভাবে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে যানবাহন ও কারখানা ছাড়াও পরিবহন শ্রমিক-মালিক সমিতির অফিস, দোকানপাট ও মার্কেট ভাঙচুর হয়েছে। লুটপাটের ঘটনাও ঘটেছে। মালিকপক্ষ শ্রমিকদের বিক্ষুব্ধ অবস্থা দেখে গাজীপুরের সব পোশাক কারখানা বৃহস্পতিবারের মতো ছুটি ঘোষণা করে। বেশ কিছু গার্মেন্টের মালিক বলছেন, তারা বাধ্য হয়ে জন্য ছুটি ঘোষণা করেছেন।
স্টাফ রিপোর্টার, নারায়ণগঞ্জ থেকে জানান, ঢাকার সাভারে ভবন ধসে শ্রমিক নিহত হওয়ার ঘটনার প্রতিবাদে নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন স্থানে ক্ষোভে ফুঁসে ওঠেন গার্মেন্ট শ্রমিকরা। বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা নারায়ণগঞ্জ-ডেমরা সড়কের আমদজী ইপিজেডের সামনে এবং ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের কাচপুর এলাকায় সকাল ১০টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। শ্রমিকরা রাস্তার ওপর অগ্নিসংযোগ করেন এবং গাছের গুঁড়ি ফেলে রাস্তায় যানবাহন চলাচলে প্রতিবন্ধকতার চেষ্টা করেন। ওই সময় তারা বেশ কয়েকটি যানবাহনও ভাঙচুর করেন। আদমজী ইপিজেডের শ্রমিকরা ইপিজেডের কাস্টমস অফিস ভাঙচুর শেষে অগ্নিসংযোগ করে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে গেলে পুলিশের সঙ্গে শ্রমিকদের ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া ঘটে। এতে শিল্প পুলিশের একজন এএসপিসহ উভয় পক্ষের কমপক্ষে ২০ জন আহত হয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে শিল্প পুলিশ আট রাউন্ড শটগানের ফাঁকা গুলি ছোড়ে। নারায়ণগঞ্জ শহরেও সাভারে শ্রমিক হতাহতের ঘটনার প্রতিবাদে দফায় দফায় মিছিল সমাবেশ করেছেন ক্ষুব্ধ শ্রমিকরা। ফতুল্লার পঞ্চবটীস্থ বিসিক শিল্প নগরীতে বিকালে ২টি মাইক্রোবাস এবং ৩টি প্রাইভেটকার ভাঙচুর করেছে বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা। পরে শ্রমিক নেতৃবৃন্দ এবং পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে পরিস্থিতি শান্ত করে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় পঞ্চবটীর বিসিক শিল্পনগরীসহ শহরের সব গার্মেন্ট ছুটি দিয়ে দেয়া হয়।
শ্রমিকদের অভিযোগ, পুলিশ বিনা উস্কানিতে শ্রমিকদের ওপর এলোপাথাড়ি পুলিশ গুলি করলে দুই শ্রমিক গুলিবিদ্ধসহ বেশ কয়েকজন আহত হয়। তবে শ্রমিকদের অভিযোগ অস্বীকার করেছে শিল্প পুলিশ। তাদের দাবি পুলিশ ফাঁকা গুলি বর্ষণ করেছে। এতে কারও আহত হওয়ার কোন সুযোগ নেই।
নারায়ণগঞ্জ শিল্প পুলিশ ৪-এর পরিচালক (পুলিশ সুপার) মাহাবুবুল আলম জানান, সকালে শ্রমিকেরা ইপিজেডের ভেতরে ভাঙচুর করার সময় পুলিশ বাধা দেয়। তখন শ্রমিকরা পুলিশের ওপর চড়াও হয়। ওই সময়ে শ্রমিকদের সঙ্গে পুলিশের ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া ঘটে। একপর্যায়ে পুলিশকে লক্ষ্য করে শ্রমিকেরা ইটপাটকেল নিক্ষেপ করতে থাকে। পুলিশ তখন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ও আত্মরক্ষার্থে ৮ রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছোড়ে।
সিদ্ধিরগঞ্জ থানার ওসি আবদুল মতিন জানান, প্রচুর পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। পরিস্থিতি বর্তমানে শান্ত।
স্টাফ রিপোর্টার, রূপগঞ্জ থেকে জানান, নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার বরাবস্থ শরীফ মেলামাইন ইন্ডাস্ট্রিজে গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে ব্যাপক হামলা, ভাঙচুর চালিয়েছেন শ্রমিকরা। সাভার ট্রাজেডির ঘটনায় রানা প্লাজার মালিক রানাকে দ্রুত গ্রেপ্তার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে দুপুরে রূপগঞ্জে কয়েকটি গার্মেন্ট শ্রমিক ঐক্যবদ্ধ হয়ে বিক্ষোভ মিছিল বের করে। এ সময় মিছিলকারীরা শরীফ মেলামাইন ইন্ডাস্ট্রিজ বন্ধের দাবি জানান।
বিক্ষুব্ধ মিছিলকারীরা শরীফ মেলামাইন মিলের প্রধান ফটক ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে ব্যাপক ভাঙচুর ও লুটপাট চালায়। এ সময় তারা মিলের ভেতরে থাকা ২টি প্রাইভেটকার, একটি ট্রাকসহ অফিস কক্ষে অগ্নিসংযোগ করে। লুটপাট করা হয়েছে কয়েক কোটি টাকার মালামাল। উত্তেজিত শ্রমিকরা ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক অবরোধ করে ১০-১২টি যানবাহন ভাঙচুর করে। এ সময় সড়কে উভয় দিকে দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়েছে। বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা সাভারের রানা প্লাজার মালিক রানাসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের গ্রেপ্তারের দাবি জানান।
শরীফ মেলামাইন ইন্ডাস্ট্রিজের প্রশাসন বিভাগের ব্যবস্থাপক তাপস কুমার সাহা জানান, শ্রমিকদের দাবি মেনে নেয়ার আগেই স্থানীয় নেতাকর্মীদের উস্কানিতে মিলে হামলা চালিয়ে ব্যাপক ভাঙচুর চালায়। শিল্প পুলিশের ওসি নজরুল ইসলাম জানান, ঘটনাস্থলে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। পরিস্থিতি এখন শান্ত। ব্যাপক যানজটের কারণে পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছতে কিছুটা বিলম্ব হয়েছে।
কালিয়াকৈর (গাজীপুর) প্রতিনিধি জানান, সাভারে ভবন ধসে শ্রমিক নিহতের ঘটনায় বৃহস্পতিবার সকালে কারখানার শ্রমিকদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেয়। সকাল থেকে কারখানা ছুটি না দেয়ায় শ্রমিকরা বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। পরে পল্লী বিদ্যুৎ এলাকার কয়েকটি কারখানার শ্রমিক উত্তেজিত হয়ে কারখানার সামনে বিক্ষোভ করেন। এ সময় শ্রমিকদের চাপের মুখে ওই সব কারখানার মালিকরা শ্রমিকদের ছুটি দিয়ে দেন। পরে ওই শ্রমিকরা একত্র হয়ে কালিয়াকৈরে যেসব কারখানা খোলা ছিল ওই সব কারখানায় গিয়ে বিক্ষোভ মিছিল করে এবং কারখানা বন্ধের দাবি জানান। পরে বেলা ১২টার দিকে কালিয়াকৈর উপজেলার সকল পোশাক কারখানা একদিনের জন্য ছুটি ঘোষণা করা হয়।