একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের বিচার কার্যক্রম নিয়ে অধৈর্য না হওয়ার জন্য দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তিতে আন্দোলনরত গণজাগরণ মঞ্চের অসন্তোষের মধ্যে বৃহস্পতিবার এক অনুষ্ঠানে তিনি এই আহ্বান জানান।
শেখ হাসিনা বলেছেন, ৩৫ বছর পর এই বিচারের কাজ শুরু করেছি।
“অনেকে অস্থির হয়ে গেছেন। আমাদের ধৈর্য ধরতে হবে। একদিনে হঠাৎ করে কিছু হবে না।”
জামায়াত নিষিদ্ধের দাবিতে সরকারের সাড়া না পেয়ে গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র গত ২৬ মার্চের সমাবেশে সরকারের সমালোচনা করেন। আন্দোলনকারীদের একটি অংশ শাহবাগে অনশনও শুরু করেছে।
৪২ বছর পর এই বিচারের কাজটি কঠিন হলে তা শেষ করতে সরকার আন্তরিক বলে সবাইকে আশ্বস্ত করেন প্রধানমন্ত্রী।
আওয়ামী লীগ সরকার যুদ্ধাপরাধীদের রায় কার্যকর করবে বলেও জানান তিনি।
যুদ্ধাপরাধের মামলায় এই পর্যন্ত তিনটি রায় এসেছে, এর মধ্যে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী এবং পলাতক আবুল কালাম আজাদের মৃত্যুদণ্ড হয়েছে। যাবজ্জীবন সাজা হয়েছে আব্দুল কাদের মোল্লার।
যুদ্ধাপরাধের রায়কে কেন্দ্র করে এই মাসের শুরুতে টানা কয়েকদিন দেশের বিভিন্ন স্থানে তাণ্ডব চালায় জামায়াতে ইসলামী। এর ফলে সৃষ্ট সহিংসতায় মারা যান ৬৭ জন। ভাংচুর ও পোড়ানো হয় দোকান-পাট, গাড়ি ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাড়ি-মন্দির।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, “এমন একটা ক্রান্তিকাল পার করছি, যখন ওই স্বাধীনতাবিরোধী চক্র দেশকে অস্থির করে তুলতে চায়।”
জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির জোটের দিকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, প্রধান বিরোধী দলের স্বাধীনতার বিরোধীদের পক্ষে যাওয়া ‘স্বাভাবিক ঘটনা’।
“তিনি(খালেদা জিয়া) স্বাধীনতায় বিশ্বাস করেন না। তিনি যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচাবেন- এটা তো অস্বাভাবিক কিছু না।”
সেনাবাহিনীকে নিয়ে বিএনপি চেয়ারপারসনের বক্তব্যেরও সমালোচনা করে আওয়ামী লীগ সভাপতি।
“উনি সেনাবাহিনীকে আহ্বান করেছেন। উনি করতেই পারেন। সেনাবাহিনীর হাত ধরে ক্ষমতার উচ্ছিষ্ট বিলিয়ে যারা দল গঠন করেন, তারা এটা করতেই পারে।”
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে শুরু হওয়া যুদ্ধাপরাধের বিচারকাজ বন্ধের জন্য জিয়াউর রহমানের সমালোচনাও করেন শেখ হাসিনা।
“যুদ্ধাপরাধীদের প্রতিষ্ঠিত করাই যেন ছিল তার(জিয়াউর রহমান) একমাত্র কাজ। স্বাধীনতার প্রতিটি চেতনা তিনি একে একে ধ্বংস করেছিলেন।”
দুই দশক আগে যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিতে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে আন্দোলন গড়ে ওঠার প্রেক্ষাপটও তুলে ধরেন আওয়ামী লীগ।
“আমরা ১৯৯২ সালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে আন্দোলন করি। তখন ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটিসহ কয়েকটি সংগঠন এই আন্দোলন করে। আমি চাচ্ছিলাম সকলে মিলে এই আন্দোলন করি। সুফিয়া কামালের কাছে যাই, আমার সঙ্গে সব সময় বেবী মওদুদ ছিল।
“সুফিয়া ফুপু বললেন, ‘আমি তো আর পারব না। তোমরা জাহানারা ইমামের কাছে যাও’। তার (জাহানারা ইমাম) সঙ্গে তিন/চারটা মিটিং হয়। সুফিয়া ফুপুর বাসায় চাদর পেতে আমরা কথা বলি।”
“এরপর শহীদ মিনারে প্রথম মিটিং হয়। সেখানে আমি উপস্থিতি ছিলাম। এরপর, অনেক ঝড়ঝঞ্ঝা গেছে। আমাদের গণআদালত করতে দেবে না। ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ সব আয়োজন করে। কীভাবে ট্রাকে মঞ্চ হবে- তাও ঠিক করা হয়। মিন্টো রোডে আমার বাসায় (বিরোধীদলীয় নেতার বাসভবন) কম্পিউটারে সব কাগজপত্র তৈরি হয়েছিল।”
মুক্তিযুদ্ধের স্লোগান ‘জয় বাংলা’ তরুণ প্রজন্মের মুখে শুনে নিজের উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা।
“আমার আনন্দ লাগে, সকলের মাঝে এই চেতনা ফিরে এসেছে। জয় বাংলা স্লোগান ফিরে এসেছে।”
ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে বৃহস্পতিবার বিকালে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর আয়োজিত বজলুর রহমান স্মৃতিপদক-২০১২ প্রদান অনুষ্ঠানে যোগ দেন শেখ হাসিনা।
সাংবাদিকদের গঠনমূলক সমালোচনার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, “এমন কিছু লেখা উচিত নয়, যা স্বাধীনতাবিরোধীদের হাতকে শক্তিশালী করবে। আবার যেন কোনো অগণতান্ত্রিক শক্তিকে ডেকে না আনে।”
সেরা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ের কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, “অনেক সংবাদপত্রের উচ্চ পদের কেউ কেউ এবং অনেক সুশীল বাবুরা সেনা সমর্থিত সরকারকে সমর্থন দিলেন। তাদের ক্ষমতায় নিয়ে আসবে। আমরা নাকি কিছুই করিনি। ওনারা দু’বছর কী উদ্ধার করলেন? তারা কি তত্ত্বাবধায়ক আমলে স্বাধীনভাবে লিখতে পেরেছেন?”
এই প্রসঙ্গে সংবাদ সম্পাদক প্রয়াত বজলুর রহমানকে স্মরণ করে তিনি বলেন, “যখন মাইনাস টু ফর্মুলা চলছিল। বজলুর রহমান ছিল তার ব্যতিক্রম। তিনি অন্যায়ের কাছে মাথা নত করেননি।
“বজলু ভাই যেমন আমার সমালোচনা করতেন, তেমনি আমার ভালো কাজের প্রশংসাও করতেন।”
ষাটের দশকে ছাত্রাবস্থায় গণতন্ত্র ও স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে পাকিস্তান সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে আন্দোলনে বজলুর রহমানের সক্রিয় অংশগ্রহণের কথা তুলে ধরেন শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, স্বাধীনতার পর বজলুর রহমান আফ্রো-এশীয় সংহতি পরিষদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়ে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্বীকৃতির জন্য বিশেষ ভূমিকা পালন করেন।
বজলুর রহমানের মৃত্যুর কথা স্মরণ করে শেখ হাসিনা বলেন, “২০০৮ সালে আমি যখন বিশেষ কারাগারে বন্দি, তখন তার মৃত্যুর সংবাদ পাই। তার সহধর্মিনী আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য বেগম মতিয়া চৌধুরীকে আমি সান্ত্বনা জানানোর সুযোগও পাইনি। এটা আমাকে এখনো কষ্ট দেয়।”
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সাংবাদিকতার জন্য দুই সাংবাদিক প্রথম আলো’র শরিফুজ্জামান পিন্টু এবং এটিএন বাংলার রাফাত মিনহাজের হাতে পদক তুলে দেন প্রধানমন্ত্রী।
জুরি বোর্ড সদস্য নওয়াজেশ আলী খান পিন্টুর এবং সেলিনা হোসেন রাহাত মিনহাজের নাম ঘোষণা করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্ আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি ডা. সারোয়ার আলী ও জিয়াউদ্দিন তারিক আলী।
অনুষ্ঠানে প্রয়াত জিল্লুর রহমান স্মরণে শোক প্রস্তাব পাঠ করেন রোবায়েত ফেরদৌস।
অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীসহ অতিথিরা গত পাঁচ বছরে মুক্তিযুদ্ধের ওপর বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন নিয়ে প্রকাশিত সঙ্কলনের মোড়ক উন্মোচন করেন।