প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘দেশের জনগণ আর কখনোই বিএনপি-জামায়াতের হত্যা ও দুঃশাসনে ফিরে যেতে চায় না। তারা চায় শান্তি ও উন্নয়ন। উন্নয়ন অব্যাহত রাখতে আমরা আপনাদের সমর্থন ও সহযোগিতা চাই। যদি সন্ত্রাসবাদ আবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে, তাহলে দেশের সব অর্জন ব্যর্থ হবে।’
গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে খুলনার সার্কিট হাউস ময়দানে আওয়ামী লীগ আয়োজিত জনসভায় প্রধানমন্ত্রী এ কথা বলেন। তিনি খুলনাবাসীর প্রতি আওয়ামী লীগকে ফের ভোট দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘আগামীতে সরকারে আসতে পারলে খুলনার উন্নয়নে বাকি সব কাজ করে দেব।’
এর আগে প্রধানমন্ত্রী খুলনা শিপইয়ার্ডে নির্মিত বাংলাদেশ নৌবাহিনীর প্রথম যুদ্ধজাহাজ বিএনএস পদ্মার কমিশনিং অনুষ্ঠানে ভাষণ দেন।
সার্কিট হাউস ময়দানে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ শুরু হয় বিকেল চারটা থেকে। ৩৩ মিনিটের ভাষণে শেখ হাসিনা বলেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে জনগণের মধ্যে সুখ-শান্তি ও সমৃদ্ধি আসে। আর বিএনপি ক্ষমতায় এলে যুদ্ধাপরাধী, রাজাকার ও জঙ্গিদের দাপটে মানুষ দিশেহারা থাকে।
এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের আমলে খুলনার জনপ্রিয় আওয়ামী লীগ নেতা মঞ্জুরুল ইমাম, সাংবাদিক হুমায়ুন কবির বালু, মানিক সাহাসহ অসংখ্য নেতা-কর্মী হত্যাকাণ্ডের কথা স্মরণ করেন।
বর্তমানে সাড়ে ছয় হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, খালেদা জিয়া তো বিদ্যুতের উৎপাদন বাড়াননি। তিনি খাম্বা কিনেছিলেন। কারণ, তাঁর ছেলে খাম্বার ব্যবসা করতেন।
শেখ হাসিনা আরও বলেন, ‘বিগত সময় আমি যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম, গত চার বছরে তার চেয়ে অনেক বেশিই করেছি। খুলনায় এক হাজার কোটি টাকার উন্নয়নকাজ চলছে।’ তিনি বলেন, ‘বিএনপির সময় বন্ধ হয়ে যাওয়া খুলনার কল-কারখানাগুলো আমরা একে একে চালু করেছি। আজই (গতকাল) দৌলতপুর জুট মিলটি চালু করেছি। বিএনপি সরকার খুলনার শিপইয়ার্ড বন্ধ করে দিয়েছিল। আমরাই তা আবার চালু করে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেছি। ভঙ্গুর শিপইয়ার্ড আজ লাভজনক প্রতিষ্ঠান।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বাচ্চু রাজাকারের (আবুল কালাম আযাদ) ফাঁসির রায় হয়েছে। আপনারা আমাদের পাশে দাঁড়ান, আগামীতে এক এক করে সব যুদ্ধাপরাধীর বিচার হবে।’
শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে শেখ হাসিনা বলেন, ‘নিজেদের যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলো, কাজের অভাব হবে না। আমরা দেশে-বিদেশে ৭৮ লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছি। দেশ এখন খাদ্যে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ।’
প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য দেওয়ার আগে যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, বহু প্রতীক্ষিত পদ্মা সেতুর পেছনে সরকার এক হাজার ৪০০ কোটি টাকার প্রস্তুতিমূলক কাজ করেছে। মূল সেতুর নির্মাণকাজ আগামী ফেব্রুয়ারি মাসেই শুরু হবে।
সরকারি বার্তা সংস্থা বাসসের খবরে বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী জনসভায় বলেন, বিদেশে বিএনপি নেত্রীর ছেলেদের পাচার করা অর্থ দেশে ফেরত আনা হয়েছে। এটা বাংলাদেশের জন্য লজ্জাজনক যে এফবিআই এজেন্টরা এ ব্যাপারে বিস্তারিত বাংলাদেশের আদালতের কাছে পেশ করেছে। বিদেশে পাচার করা অর্থের কিছু অংশ সিঙ্গাপুরের ব্যাংক থেকে ফেরত আনা হয়েছে। পাচার করা সব অর্থ দেশে ফেরত আনা হবে।
খুলনা নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সিটি করপোরেশনের মেয়র তালুকদার আবদুল খালেকের সভাপতিত্বে জনসভায় বক্তব্য দেন দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও পাটমন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকী, আরেক সদস্য মোহাম্মদ নাসিম, স্বাস্থ্যমন্ত্রী আ ফ ম রুহুল হক, শ্রম প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ান, আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ, বাগেরহাটের সাংসদ শেখ হেলাল উদ্দিন, খুলনার সাংসদ ননী গোপাল মণ্ডল, মোল্লা জালাল উদ্দিন ও সোহরাব আলী সানা, খুলনা জেলা পরিষদের প্রশাসক ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হারুনুর রশীদ প্রমুখ।
পদ্মার কমিশনিং: সকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খালিশপুরে বিএনএস তিতুমীর ঘাঁটিতে পৌঁছানোর পর তাঁকে স্বাগত জানান নৌবাহিনীর প্রধান অ্যাডমিরাল জহির উদ্দিন আহমেদ ও কমোডর এম এ রাজীব। পরে নৌবাহিনীর একটি সুসজ্জিত দল প্রধানমন্ত্রীকে গার্ড অব অনার দেয়। প্রধানমন্ত্রী দেশে নির্মিত প্রথম যুদ্ধজাহাজ পদ্মার কমিশনিং ওয়ারেন্ট জাহাজটির কমান্ডার শফিউল আজমের হাতে তুলে দেন। তিনি জাহাজটি পরিদর্শনও করেন।
পরে সেখানে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা যুদ্ধবিগ্রহ নয়, শান্তি চাই। কিন্তু আত্মরক্ষা করার মতো ক্ষমতাও আমাদের থাকা দরকার।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘নৌবাহিনীকে একটি “ডিটারেন্ট ফোর্স” হিসেবে গড়ে তুলতে ঘাঁটি-সুবিধাসহ অতি শিগগির সাবমেরিন সংযোজন করা হবে। গড়ে তোলা হবে আধুনিক ত্রিমাত্রিক নৌবাহিনী। এটি আমাদের জলসীমায় যুদ্ধের সময় যেকোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সক্ষম হবে। সোনাদিয়ায় পরিকল্পিত গভীর সমুদ্রবন্দর স্থাপনের মাধ্যমে বৈদেশিক বাণিজ্য বহুলাংশে বৃদ্ধি পাবে। সরকার ইতিমধ্যেই রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক অঙ্গনে সহযোগিতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রতিবেশী দেশগুলোর জন্য মংলা ও চট্টগ্রাম বন্দর উন্মুক্ত করা হয়েছে।’
উদ্বোধন ও ভিত্তিপ্রস্তর: প্রধানমন্ত্রী সার্কিট হাউস ময়দানে জনসভাস্থলে মঞ্চের পশ্চিম পাশে প্রতীকীভাবে ১১টি ফলক উন্মোচন করেন। এর মধ্যে খুলনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন একাডেমিক ভবন, ৬০০ শয্যার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল ও ছাত্রকল্যাণ কেন্দ্র, শহীদ শেখ আবু নাসের ক্রিকেট স্টেডিয়াম, খুলনা মেডিকেল কলেজের শহীদ জননী জাহানারা ইমাম মহিলা মিলনায়তন, খুলনা বিভাগীয় মহিলা ক্রীড়া কমপ্লেক্স হোস্টেল ও খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভ ‘অদম্য বাংলা’। এ ছাড়া তিনি খুলনা ওয়াসা ভবন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রী হোস্টেল ও খুলনা শিশু হাসপাতালের একটি নতুন ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।