মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় জামায়াতে ইসলামীর সাবেক সদস্য (রুকন) আবুল কালাম আযাদের ফাঁসির আদেশ হয়েছে। আজ সোমবার বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এ রায় ঘোষণা করেন।
আযাদ পলাতক থাকায় তাঁর অনুপস্থিতিতেই এই রায় দেন আদালত। এটি একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধকালে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় করা মামলার প্রথম রায়।
স্থানসংকুলান না হওয়ায় আজ ট্রাইব্যুনাল-২-এর কার্যক্রম ট্রাইব্যুনাল-১-এ বসে। বেলা পৌনে ১১টায় রায় পড়া শুরু করেন ট্রাইব্যুনাল-২-এর চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান। এ সময় ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য বিচারপতি মো. মজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি শাহিনুর ইসলাম উপস্থিত ছিলেন।
শুরুতে ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বলেন, এটা ১১২ পৃষ্ঠার একটি রায় এবং এখানে ৩৩৪টি অনুচ্ছেদ আছে।
১১টা ৫০ মিনিটে সংক্ষিপ্ত রায় পড়া শেষ হয়। রায়ে ট্রাইব্যুনাল-২ বলেন, আযাদের বিরুদ্ধে আনা আটটি অভিযোগের মধ্যে সাতটি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। একটি অভিযোগ প্রমাণ হয়নি।
রায়ে ট্রাইব্যুনাল-২ বলেন, হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষণ এবং এ ধরনের কাজে সহযোগিতার জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন, ১৯৭৩ অনুসারে আসামির সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করা হলো।
রায়ে বলা হয়, তৃতীয়, চতুর্থ, ষষ্ঠ ও সপ্তম অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় আসামিকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়েছে। প্রথম, পঞ্চম ও অষ্টম অভিযোগও প্রমাণিত হয়েছে। তবে ইতিমধ্যে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেওয়ার কারণে এসব অভিযোগে আলাদা করে কারাদণ্ড দেওয়া হচ্ছে না। দ্বিতীয় অভিযোগটি প্রমাণিত হয়নি। তাই ওই অভিযোগ থেকে তাঁকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
পুলিশ যাতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক আযাদকে গ্রেপ্তারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়, এ ব্যাপারেও আদেশ দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল-২।
আযাদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গত বছরের ২৬ ডিসেম্বর যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ হয়। এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি ছিলেন সাহিদুর রহমান। রাষ্ট্রনিযুক্ত আসামিপক্ষের আইনজীবী ছিলেন আবদুস শুকুর খান।
মামলা ও বিচার কার্যক্রম:
আযাদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগের তদন্ত শুরু হয় ২০১১ সালের ১০ এপ্রিল। এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা নূর হোসেন।
গত বছরের ২৫ মার্চ রাষ্ট্রপক্ষ তদন্তের বিষয়টি ট্রাইব্যুনাল-২-এ আনে এবং ‘সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে’ আযাদকে গ্রেপ্তারের আবেদন করে।
৩ এপ্রিল ট্রাইব্যুনাল আযাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। সেদিন রাজধানীর উত্তরখানে আযাদের বাসভবন ‘আযাদ ভিলা’য় গিয়ে পুলিশ তাঁকে পায়নি। এর আগেই তিনি পালিয়ে যান।
২৫ সেপ্টেম্বর জাতীয় দৈনিকে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে তাঁকে সাত দিনের মধ্যে ট্রাইব্যুনালে হাজির হতে বলা হয়। তিনি হাজির না হওয়ায় ট্রাইব্যুনাল তাঁকে পলাতক ঘোষণা করে তাঁর অনুপস্থিতিতে বিচারকাজ শুরু করেন। ট্রাইব্যুনাল ৭ অক্টোবর তাঁর পক্ষে আইনজীবী হিসেবে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. আবদুস শুকুর খানকে নিয়োগ দেন।
গত বছরের ৪ নভেম্বর আযাদের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধকালে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের আটটি অভিযোগ গঠন করেন ট্রাইব্যুনাল। ২৬ নভেম্বর রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়, চলে ২০ ডিসেম্বর পর্যন্ত। তদন্ত কর্মকর্তাসহ রাষ্ট্রপক্ষের ২২ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য নেওয়া হয়। তবে আসামিপক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী কোনো সাক্ষী হাজির করতে পারেননি।
২৩ ডিসেম্বর দুই পক্ষের যুক্তি উপস্থাপন শুরু হয়। ২৬ ডিসেম্বর যুক্তি উপস্থাপন শেষে ট্রাইব্যুনাল মামলার রায় অপেক্ষমাণ রাখেন।
আযাদের বিরুদ্ধে আট অভিযোগ:
ট্রাইব্যুনাল আযাদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন, ১৯৭৩-এর ৩ (২) ধারায় আট ধরনের অভিযোগ গঠন করেন।
প্রথম অভিযোগ অনুসারে, একাত্তরের জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে আযাদ ও তাঁর সহযোগীরা ফরিদপুর শহরের খাবাশপুর থেকে রণজিত্ নাথ ওরফে বাবুনাথকে ধরে নির্যাতন করেন। তবে রাত দুইটা-আড়াইটার দিকে তিনি পালাতে সক্ষম হন।
দ্বিতীয় অভিযোগ, ২৬ জুলাই আলফাডাঙ্গা থেকে আবু ইউসুফ পাখিকে ধরে এনে ফরিদপুর স্টেডিয়ামে আটক রাখা হয়। আযাদ পাকিস্তানি মেজর আকরামের সঙ্গে আলোচনা করে পাখিকে আটক রাখেন এবং অমানবিক নির্যাতন করেন।
তৃতীয় অভিযোগ, ১৪ মে আযাদ ফরিদপুরের বোয়ালমারী থানার কলারন গ্রামের জমিদার সুধাংশু মোহন রায় ও তাঁর বড় ছেলে মণিময় রায়কে বাড়ির পাশের রাস্তায় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে বাড়ি ফিরতে বলেন। তাঁরা বাড়ির দিকে রওনা হলে আযাদ পেছন থেকে রাইফেল দিয়ে গুলি করেন। এতে সুধাংশু নিহত ও মণিময় গুরুতর আহত হন।
চতুর্থ অভিযোগ, ১৬ মে আযাদ রাজাকারদের নিয়ে সালথা থানার (সাবেক নগরকান্দা) পুরুরা নমপাড়া গ্রামে মাধবচন্দ্র বিশ্বাসের বাড়িতে লুটপাট করেন। মাধবকে বাড়ি থেকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে আযাদ গুলি করে হত্যা করেন।
পঞ্চম অভিযোগ অনুসারে, ৮ জুন আযাদ ও তাঁর চার-পাঁচজন