সরকারের হঠাৎ জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর ফলে জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়বে প্রায় সব ক্ষেত্রে। এ মূল্যবৃদ্ধি দেশে খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতিকে আরও উসকে দেবে। বেড়ে যাবে পরিবহন ব্যয়। যানবাহনের ভাড়া নিয়ে নৈরাজ্য সৃষ্টিরও আশঙ্কা করা হচ্ছে। এছাড়া বোরো মওসুমে কৃষকরাও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই সরকারের এ সিদ্ধান্তকে ভালোভাবে দেখছেন না দেশের অর্থনীতিবিদেরা। তাদের প্রশ্ন, তেলের দাম বাড়ানোর ফলে যে অর্থের সাশ্রয় হবে, সেটা কোন খাতে ব্যয় হবে? এদিকে সরকারের এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে রোববার ১৮ দলীয় জোট সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডেকেছে। তবে সরকার ও বিরোধী দলীয় জোটের এ সিদ্ধান্তকে ভালভাবে নিচ্ছেন না ব্যবসায়ীরা। তারা জানান, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর ফলে চাল, ভোজ্য তেল, কাঁচা-তরকারিসহ যাবতীয় নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাবে। দূরপাল্লার পরিবহন ছাড়াও অভ্যন্তরীণ রুটে এবং রপ্তানি পরিবহনের জন্যও বাড়তি টাকা গুণতে হবে সবাইকে।
যোগাযোগ করা হলে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য মানবজমিনকে বলেন, জ্বালানি তেলের আন্তর্জাতিক বাজারমূল্য, সরকারের বর্তমান রাজস্ব-পরিস্থিতি ও রাজনৈতিক বিবেচনায় দাম বাড়ানোর দরকার ছিল না। এই মূল্যবৃদ্ধি দেশে খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতিকে আরও উসকে দেবে। তিনি বলেন, আশা করেছিলাম বোরো চাষের জন্য সরকার ডিজেলের দাম না বাড়িয়ে কৃষককে রক্ষা করবে। কিন্তু সেটা আর হলো না। তবে এখন গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে, তেলের দাম বাড়ানোর ফলে যে অর্থের সাশ্রয় হবে, সেটা কোন খাতে ব্যয় হবে। এ ব্যয়ের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা থাকলে জনগণের জন্য মূল্যবৃদ্ধি মেনে নেয়া সহজ হতে পারে বলে তিনি জানান।
অর্থনীতিবিদ ও তেল-বিদ্যুৎ-গ্যাস-বন্দর ও খনিজসম্পদ রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব ড. আনু মুহাম্মদ বলেন, জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির ফলে চাল, ডাল, তেল, তরিতরকারি এবং পরিবহন ভাড়া বাড়বে। যা সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ আরও বাড়িয়ে দেবে। তিনি বলেন, তেল ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র করার কারণেই তেলের ওপর চাপ বাড়ছে। যেখানে সরকার কোটি কোটি টাকা ভর্তুকি দিচ্ছে। যার জন্য সরকার তেলের দাম বাড়াতে বাধ্য হয়েছে বলে মনে করেন তিনি। তবে এতে সরকারের কিছু লোক লাভবান হবে। এছাড়া আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত মেনেই তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে। এখন পর্যন্ত একটি কিস্তির অর্থ পেয়েছে। দ্বিতীয় কিস্তির অর্থ পেতেই সরকারের এ সিদ্ধান্ত। তিনি বলেন, জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে, তাদেরই মাথায় আবার বাড়ি দিচ্ছে সরকার। আর এতে করে দুর্যোগটা পড়বে দেশের অর্থনীতির ওপরই। বিশেষ করে যারা সিএনজি (সংকুচিত প্রাকৃতিক গ্যাস) ব্যবহার করছে তারাও ভাড়া বাড়িয়ে দেবে এ অজুহাতে। পূর্বের মতো সরকার এই খাতে সৃষ্ট অস্থিরতাকেও সামাল দিতে পারবে না।
প্রসঙ্গত, এর আগে ২০১১ সালের ৩০শে ডিসেম্বর সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম লিটারপ্রতি ৫ টাকা বাড়ানো হয়েছিল। এই সরকারের আমলে এ নিয়ে ৫ বার জ্বালানি তেলের দাম বাড়লো। এর মধ্যে প্রতি লিটার অকটেন ৫ টাকা বেড়ে হয়েছে ৯৯ টাকা। পেট্রলের দর বেড়েছে লিটারপ্রতি ৫ টাকা। এখন প্রতি লিটার পেট্রল কিনতে হবে ৯৬ টাকায়। আর ডিজেল ও কেরোসিন লিটারে ৭ টাকা করে বেড়ে হয়েছে ৬৮ টাকা। ফার্নেস তেল ও জেট ফুয়েলের দাম বাড়ানো হয়নি। তবে এ দুটিতে সরকারের কোন ভর্তুকি লাগে না। অকটেন ও পেট্রলেও ভর্তুকি লাগে না। এর পরও এই দুটির দাম বাড়ানো হলো। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত মেনেই তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে। ১০০ কোটি ডলারের বর্ধিত ঋণসুবিধার আওতায় (ইএসএফ) বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত একটি কিস্তির অর্থ পেয়েছে। দ্বিতীয় কিস্তির ১৪ কোটি ১০ লাখ ডলার চলতি জানুয়ারি মাসেই পাওয়ার কথা। এই অর্থ পেতেই বাড়ানো হলো জ্বালানি তেলের দাম।