রাজধানীর হাতিরঝিল-বেগুনবাড়ি সমন্বিত উন্নয়ন প্রকল্প উদ্বোধন করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, নতুন বছরের শুরুতে ঢাকাবাসীর জন্য উপহার এই প্রকল্প।
সম্পূর্ণ নিজস্ব তত্ত্বাবধানে পাঁচ বছর ধরে কাজ চালিয়ে এই প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞ, সেনাবাহিনী, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা- কর্মচারী ও শ্রমিকদের ধন্যবাদ জানিয়েছেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী বুধবার সকালে এ প্রকল্পের ফলক উন্মোচন করে প্রকল্প এলাকা সবার জন্য খুলে দেয়ার ঘোষণা দেন।
রাজধানীর পূর্ব থেকে পশ্চিমে যোগাযোগ সহজতর করার পাশাপাশি নগরবাসীর জন্য একটি বিনোদনের স্থান হিসাবে গড়ে তোলা হয়েছে সোনারগাঁও থেকে রামপুরা পর্যন্ত ৩০২ একর জমির উপর বিস্তৃত এই প্রকল্প।
হাতির ঝিলের গুলশান প্রান্তে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা আন্তরিকতা ও দায়িত্বশীলতার সঙ্গে কাজ না করলে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে এ প্রকল্পের কাজ শেষ হতো না।
বিদেশি পরামর্শক ও সহযোগিতা ছাড়া এই প্রকল্প বাস্তবায়ন শুধু ঢাকা নয়, বিশ্বের জন্য একটি দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
বেগুনবাড়ি- হাতিরঝিল প্রকল্পের গুরুত্ব তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এর আগে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার পর এই ঝিল বন্ধ করে এখানে স্কুল, প্লট ও ঘর-বাড়ি করার অনেক প্রস্তাব আসে।
“কিন্তু আমি সেগুলো বাতিল করে দিই।”
বন্যাসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে রাজধানীতে পানি নিষ্কাশনের সুযোগ রাখার জন্য জলাধার ও খাল-ঝিল সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা থেকে সেসব প্রস্তাব নাকচ করা হয় বলে প্রধানমন্ত্রী জানান।
পরিবেশের সুরক্ষার জন্য যে কোনো প্রকল্প করতে হলে সেখানে জলাধার ও খাল থাকতে হবে বলে নির্দেশ দেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমরা আগামী প্রজন্মের জন্য উন্নত সমাজ ব্যবস্থা রেখে যেতে চাই। এই প্রকল্প বাস্তবায়নের কারণে ঢাকাবাসী স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার একটি জায়গা পেল।”
“আমরা দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পেরেছি- আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে সব কাজ করতে পারি”, বলেন শেখ হাসিনা।
প্রকল্প এলাকায় যে গাছ রোপণ করা হয়েছে, তা বড় হলে হাতির ঝিলের ‘চেহারা পাল্টে’ যাবে বলেও মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রী।
বারো মাসে তের পার্বনের এই দেশে মানুষ এখানে এসে বিভিন্ন অনুষ্ঠান-উৎসব উপভোগ করতে পারবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
এ প্রকল্পের কারণে ক্ষতিগ্রস্তদের ফ্ল্যাট এবং যাদের জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে- তাদের প্লট দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী আব্দুল মান্নান খানকে নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত পরিবশেবিদ ও কলাম লেখক আবুল মকসুদেকে উদ্দেশ্য করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেন, “আজ নাকি পরিবেশবাদীরা বিক্ষোভ করবেন। আমি এখানে এসে মকসুদ সাহেবকে দেখে আশ্বস্ত হয়েছি- বিক্ষোভ হবে না।”
“উনি (আবুল মকসুদ) বললেন, এই প্রকল্প দেখে উনিও উৎফুল্ল”, বলেন আশরাফ।
প্রকল্প বাস্তবায়নকালে গণমাধ্যমে বিভিন্ন সমালোচনামূলক খবর প্রকাশ হয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যে কোনো ভালো কাজের জন্য একটু ধৈর্য্য ধরতে হয়।
তিনি বলেন, “বিভিন্ন সংবাদ পরিবেশন করা হয়। যাতে মানুষের মনে হতাশার সৃষ্টি হয়।”
এ ধরনের সমালোচনায় যাতে হতাশা সৃষ্টি না হয়, কাজ করার মানসিকতা হারিয়ে না যায়- সেদিকে লক্ষ্য রাখতে আহ্বান জানান তিনি।
শেখ হাসিনা বলেন, “যারা সমালোচনা করেন- তাদের আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। তারা সমালোচনা দিয়েছিল বলেই হয়তো আমরা এই প্রকল্পে বিশেষ নজর দিয়েছি।”
“যারা সমালোচনা করেন- তাদের আমি বলব, সমালোচনা করেন, হতাশার সৃষ্টি করবেন না। যাতে কাজ করার আগ্রহ হারিয়ে না যায়”, বলেন সরকার প্রধান।
হাতির ঝিল- বেগুনবাড়ি প্রকল্পের ফলে ঢাকাবাসী একটি নির্মল পরিবেশ পাবে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশের মানুষের সুস্থ, সুন্দর ও উন্নত জীবন নিশ্চিত করতে সরকার কাজ করে যাচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রীর উদ্বোধনের পর হাতির ঝিলে এক ঝাক রাজহাঁস ছেড়ে দেয়া হয়। এক সময় দুর্গন্ধময় কালো পানির জায়গায় স্বচ্ছ পানিতে দেখা যায় হাঁসের জলকেলি। সেখানে আয়োজন করা হয় নৌকাবাইচের।
হাতির ঝিল নাম বলে প্রকল্প এলাকায় দুটি হাতিও আনা হয়। খালপাড়ের সড়কের ধারে বাদ্য বাজাতে দেখা যায় ঢুলিদের।
প্রকল্প এলাকা চলাচলের জন্য খুলে দেয়া উপলক্ষে খালের দ্ইু পাড় ও সড়কগুলো সাজানো হয় ফুলের টব ও নানা রঙের পতাকা দিয়ে।
প্রধানমন্ত্রীর আগমণ উপলক্ষে গুলশান লিংক রোডসহ বেশ কয়েকটি সড়কে যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা হয়।
রাজধানীর পুর্ থেকে পশ্চিমের যোগাযোগ বাড়ানোর লক্ষ্যে গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় প্রায় ২ হাজার কোটি টাকার এ প্রকল্প হাতে নেয়া হয়, যা বাস্তবায়নে ৯৩ শতাংশ অর্থের জোগান দেয় সরকার।
২০০৭ সালের ৮ অক্টোবর একনেকে এক হাজার ৪৭৩ কোটি ৫৮ লাখ টাকার এই প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। পরে, ভূমি অধিগ্রহণ ব্যয়সহ সংশোধিত প্রকল্প ব্যয় দাঁড়ায় এক হাজার ৯৭১ কোটি ৩০ লাখ টাকা।
সমন্বিত এ প্রকল্পের প্রাণ হাতিরঝিল ও বেগুনবাড়ি খাল, যার দুই পাশ দিয়ে যানবাহন চলাচলের জন্য তৈরি করা হয়েছে ১৬ কিলোমিটার সড়ক, চারটি সেতু, আরো চারটি ক্ষুদ্র সেতু (ভায়াডাক্ট) এবং চলাচলের জন্য চারটি ওভারপাস।
বিনোদনের জন্য খালে থাকছে নৌকা চালানোর ব্যবস্থা, ছোট পরিসরে পিকনিক স্পটসহ বেশ কিছু সুবিধা।
এ প্রকল্পে আড়াই হাজার আসনের একটি উন্মুক্ত মঞ্চ, রামপুরা প্রান্তে রাস্তায় দুটি ইউ-লুপ, পানির ওপর দর্শণার্থী ডেক, জলযান টার্মিনাল, হাঁটার সেতু, সাংস্কৃতিক ও ব্যবস্থাপনা ভবন এবং পাবলিক টয়লেট নির্মণেরও কাজ চলছে, যা ২০১৪ সালের জুন মাসের মধ্যে শেষ হবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সকাল সাড়ে ১০টার দিকে প্রকল্প এলাকায় পৌঁছে প্রথমে প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলেন। তারপর প্রধানমন্ত্রী গাড়িতে করে খালের ওপর নির্মিত সেতু ও সড়ক দিয়ে ঘুরে ঘুরে অনুষ্ঠান মঞ্চে পৌঁছান। এ সময় দুই তরুণী ফুলের তোড়া দিয়ে তাকে স্বাগত জানায়।
অনুষ্ঠানস্থলে পৌঁছে প্রধানমন্ত্রী শুরুতেই হাতিরঝিল প্রকল্পের ফলক উন্মোচন করেন এবং মোনাজাতে অংশ নেন। এরপর তিনি মঞ্চে আসন নিলে দর্শকসারি থেকে জয় বাংলা শ্লোগানে তাকে স্বাগত জানানো হয়।
গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রনালয়ের সচিব খোন্দকার শওকত হোসেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে আব্দুল মান্নান খান, স্থানীয় সাংসদ আসাদুজ্জামান খান কামাল, সরকার দলীয় সাংসদ এ কে এম রহমত উল্লাহ এবং সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের স্পেশাল ওয়ার্কস অরগানাইজেশনের মহাপরিচালক ও এই প্রকল্পের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবু সাইদ মোহাম্মদ মাসুদ বক্তব্য রাখেন।
অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান মো. নুরুল হুদা।
প্রকল্প পরিচালক এএসএম রায়হানুল ফেরদৌস বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, বিনোদনকেন্দ্র হিসেবে এই প্রকল্পকে প্রস্তুতে আরো কিছু কাজ বাকি রয়েছে, যা শিগগিরই করা হবে।
প্রকল্পটি চালু হলে পূর্ব অংশের রামপুরা, বাড্ডা থেকে সহজেই শহরের কেন্দ্রস্থল কারওয়ান বাজারে পৌঁছানো যাবে বলে জানান রায়হানুল ফেরদৌস।
গাড়িতে এ এলাকায় প্রবেশ ও বের হওয়ার জন্য এফডিসির পাশের মোড়ে, মগবাজার রেল ক্রসিং ও রামপুরা সেতুর কাছে তিনটি পথ থাকছে। এ প্রকল্প উন্মুক্ত হওয়ায় যানজট কিছুটা হলেও কমবে বলে আশা করছেন সগক যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরাও।
২০০৭ সালে হাতিরঝিল উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ শুরু হলেও প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদন পায় ২০০৮ সালের ২৮ ডিসেম্বর, যা ছিল সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শেষ একনেক বৈঠক।
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, সেনাবাহিনীর ১৬ ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন ব্যাটালিয়ন, ঢাকা ওয়াসা এবং এলজিইডি যৌথভাবে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করে। প্রকল্পে পরামর্শকের দায়িত্বে ছিল বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়।
ইতিহাস বলে, ঢাকার পিলখানা (হাতির আবাস) থেকে বেগুনবাড়ি এলাকার ঝিলে যাওয়ার জন্য হাতিরা যেসব সড়ক ব্যবহার করতো, পরবর্তীতে সেসব এলাকার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে হাতি নামটি। যেমন এলিফ্যান্ট রোড বা হাতিরপুল। ঝিলের নামকরণের পেছনেও কারণ অভিন্ন।