আগামী ১৯শে জানুয়ারির মধ্যে সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনির হত্যাকারীদের গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়েছেন সাংবাদিক নেতারা। পাশাপাশি অতীতের সব সাংবাদিক হত্যার বিচার শুরু এবং সাংবাদিক নির্যাতন বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন তারা। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে দাবি আদায় না হলে ২০শে জানুয়ারি জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে সাংবাদিক মহাসমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে। ওই মহাসমাবেশে সারা দেশ থেকে সাংবাদিকরা এসে গোটা সচিবালয় অবরোধ করে রাখবে। ৩ দফা দাবিতে গতকাল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঘেরাও কর্মসূচি শেষে নেতারা এসব ঘোষণা দেন। তারা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও তথ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করে বলেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মিথ্যাচারের মাধ্যমে সাংবাদিকদের উস্কে দিচ্ছেন। তথ্যমন্ত্রী সংসদে বিভ্রান্তিকর তথ্য দিচ্ছেন। এ দুই মন্ত্রীকে সাংবাদিকদের শত্রু হিসেবেও উল্লেখ করেছেন সাংবাদিক নেতারা। গতকালের কর্মসূচিতে অংশ নেয় বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে) ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন (ডিইউজে), জাতীয় প্রেস ক্লাব, ক্রাইম রিপোর্টার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশে (ক্রাব) এবং রিপোর্টার্স এগেইন্ট করাপশন (র্যাক)সহ সাংবাদিকদের বিভিন্ন সংগঠন।
বিএফইউজে সভাপতি ইকবাল সোবহান চৌধুরী বলেন, নতুন বছরের প্রথম দিনে আমাদের রাজপথে থাকার কথা ছিল না। গত বছর এ দিনে সাগর-রুনির পুত্র সন্তান তার বাবা-মায়ের সঙ্গে নববর্ষ উদ্যাপন করেছে। উৎসব করেছে। এবার কেবল চোখের জল মুছছে। তার চোখের জল দেখে আমরা অশ্রু সংবরণ করতে পারছি না। কিন্তু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের কটাক্ষ করছেন। তিনি বলেন, অতীতে কোন সাংবাদিক হত্যার বিচার হয়নি। সাগর-রুনির হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না। তাহলে কি বলতে পারি- দেশে আইনের শাসন আছে? তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীরের বক্তব্যের কড়া সমালোচনা করে বলেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এখনও সাংবাদিকদের চাপ অনুভব করছেন না। যেদিন অনুভব করবেন সেদিন পালানোর পথ খুঁজে পাবেন না। তিনি বলেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কি প্রধানমন্ত্রীর চেয়ে বড় হয়ে গেছেন? আমরা যেদিন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের দিকে স্মারকলিপি নিয়ে যাচ্ছিলাম সেদিন প্রধানমন্ত্রী তার প্রেস সচিবকে পাঠিয়ে আমাদের কাছ থেকে স্মারকলিপি নিয়ে গেছেন। আজ যখন আমরা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় ঘেরাও কর্মসূচি দিলাম তখন মন্ত্রী বলছেন, ঘেরাও কর্মসূচি দিয়ে বিচার ত্বরান্বিত করা যাবে না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, আপনি যখন নির্যাতিত হয়েছিলেন তখন সাংবাদিকরা আপনার পাশে ছিল। আজ আপনি আমাদের সঙ্গে তামাশা করছেন। আমরা আন্দোলনের এমন জোয়ার গড়ে তুলবো যাতে বানের পানির মতো অনেকেই ভেসে যাবে। তিনি ২০১৩ সালকে সাংবাদিকদের দাবি আদায়ের বছর হিসেবে উল্লেখ করেন।
কর্মসূচিতে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন বিএফইউজের অপর অংশের সভাপতি রুহুল আমিন গাজী, জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আবদাল আহমেদ, ডিইউজের সভাপতি ওমর ফারুক ও আবদুস শহীদ, সাধারণ সম্পাদক বাকের হোসাইন ও শাবান মাহমুদ, সাংবাদিক নেতা মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল, বিএফইউজের মহাসচিব আবদুল জলিল ভূঁইয়া, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) সভাপতি শাহেদ চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক ইলিয়াস খান প্রমুখ।
রুহুল আমিন গাজী বলেন, ১৯শে জানুয়ারির মধ্যে খুনিদের ধরা না হলে ২০ তারিখ সাংবাদিকরা যে কর্মসূচি দেবে তাতে অনেককেই বিদায় নিতে হবে। তিনি বলেন, বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ড এবং শীর্ষ সন্ত্রাসী বিকাশের মুক্তির দায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকেই নিতে হবে। আবদুল জলিল ভুঁইয়া বলেন, সাগর-রুনির রক্তে সাংবাদিকরা ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। এ ঐক্য ভাঙা যাবে না। হত্যাকারীদের বাঁচানোর চক্রান্ত চলছে। চক্রান্তকারীদেরও আইনের আওতায় আনতে হবে। তিনি বলেন, স্বারষ্ট্রমন্ত্রী শুদ্ধ বাংলায় কথা বলেন। অথচ মেঘ ও সাগর-রুনির মায়ের কান্নার আওয়াজ শুনতে পান না। মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল বলেন, যখন সাংবাদিকতায় এসেছিলাম তখন মেনেই নিয়েছিলাম রুটি-রুজি ও চাকরির জন্য আন্দোলন করতে হবে। বেঁচে থাকার জন্য বা খুনের বিচার চাওয়ার জন্য যে আন্দোলন করতে হবে তা ভাবিনি। মন্ত্রীদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, সচিবালয়ের ভেতরে আরামে থেকে চিরকাল ভাল কথা বলা যাবে না। মেয়াদ শেষ হলেই জনগণের কাছে আসতে হবে। এটাই আসল জায়গা। তাই জনগণের মনের কথা ভেবে সাগর-রুনিসহ সব সাংবাদিক হত্যার বিচার করুন। তিনি বলেন, দেশের ভেতর কোন খুন হলে কি আমরা দেশের বাইরে গিয়ে বিচার চাইবো? সাংবাদিক খুন হলে যে বিচার হয় না তা আজ প্রতিষ্ঠিত সত্য। তিনি বলেন, যেসব দেশে সাংবাদিক হত্যার বিচার হয় না সেসব দেশের মধ্যে বাংলাদেশের স্থান প্রথম। পৃথিবীর কোন দেশেই সাংবাদিকরা এত অসহায় নন। তিনি বলেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও তথ্যমন্ত্রীর ব্যর্থতার দায় সরকারকেই নিতে হবে। আবদুস শহীদ বলেন, সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডে ডিবি ব্যর্থ হয়েছে। মনে হচ্ছে র্যাবও ব্যর্থ। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ও ব্যর্থ। এটা কোন সভ্য দেশে হতে পারে না। তিনি বলেন, দাবি আদায়ের ক্ষেত্রে সরকারের দুই মন্ত্রীই সবচেয়ে বড় বাধা। তিনি বলেন, আমরা অসত্যবাদী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর চেহারা দেখতে চাই না। তথ্যমন্ত্রীর বিভ্রান্তিকর বক্তব্য শুনতে চাই না। ওমর ফারুক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বলেন, আপনি আওয়ামী লীগের টিকিটে নির্বাচিত হয়ে মন্ত্রী হয়েছেন। আপনি এখন প্রজাতন্ত্রের মন্ত্রী। সাংবাদিক হত্যাকাণ্ডের বিচার করুন। না হলে আপনাকেও বিদায় নিতে হবে। ২০শে জানুয়ারি এমন কঠোর কর্মসূচি দেবো যা আপনি চিন্তাও করতে পারবেন না। তিনি বলেন, যে পুলিশ আদালতে গিয়ে নিজেদের ব্যর্থতার কথা স্বীকার করে সে পুলিশের চাকরি থাকে কিভাবে? শাবান মাহমুদ বলেন, ২০শে জানুয়ারির আগে খুনিরা গ্রেপ্তার না হলে আমরা মন্ত্রণালয় কিংবা সচিবালয়ের সামনে থেকে সরে যাবো না। প্রয়োজনে গোটা সচিবালয় অবরুদ্ধ করে রাখা হবে। বাকের হোসাইন বলেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় কথা রাখেনি। সাংবাদিকদের স্বাধীন সাংবাদিকতার কাজে পদে পদে বাধা দেয়া হচ্ছে। প্রয়োজনে জাতীয় কনভেনশন ডেকে সাগর-রুনির হাত্যাকারীদের বিচারের আওতায় আনা হবে। শাহেদ চৌধুরী বলেন, সৌদি দূতাবাসের কর্মকর্তা খালাফ হত্যাকাণ্ডের বিচার স্বল্প সময়ে হয়েছে। সরকার ইচ্ছা করলে সবই করতে পারে। সাংবাদিক হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারেও ব্যবস্থা নিন। না হলে আমরা জানি কিভাবে দাবি আদায় করতে হয়। সোজা আঙুলে ঘি ওঠে না। প্রয়োজনে আঙুল বাঁকা করবো।
উল্লেখ্য, গতকাল বেলা ১২টার দিকে প্রেস ক্লাবের সামনে থেকে মিছিল নিয়ে সাংবাদিকরা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের দিকে অগ্রসর হন। বিদ্যুৎ ভবনের সামনে গেলে পুলিশ সামান্য বাধা দেয়। বাধা উপেক্ষা করে তারা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের দিকে এগোতে থাকে। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে সাংবাদিকরা সচিবালয়ের ১ নম্বর ও ২ নম্বর গেটের মাঝখানে মূল সড়কে অবস্থান নেন। এর আগেই সচিবালয়ের সব ফটক বন্ধ করে দেয়া হয়।