আসিফ নজরুল | তারিখ: ৩০-১২-২০১২
এরশাদের সঙ্গে দুই নেত্রীর এমনিতে তুলনাই হতে পারে না। এরশাদ স্বৈরশাসক এবং অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারী ছিলেন। দু্ই নেত্রী জনমানুষের নেত্রী, জনগণের ভোট পেয়ে তাঁরা বারবার নির্বাচিত হয়েছেন। ব্যক্তিচরিত্রের দিক দিয়েও এরশাদ দুই নেত্রীর সঙ্গে তুলনীয় হতে পারেন না। কিন্তু তাই বলে এরশাদের আমলের সঙ্গে কি দুই নেত্রীর গণতান্ত্রিক আমলের তুলনামূলক আলোচনা করা যায় না? আমি মনে করি, করা যায়। করা যায় যে তার প্রধান কারণ স্বৈরশাসক ও দুর্নীতিবাজ এরশাদকে সরিয়েই ক্ষমতায় এসেছিলেন দুই নেত্রী। এরশাদের পতন হলে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে, দেশে সুশাসন আসবে, মানুষের অভাব আর বঞ্চনা দূর হবে—এই স্বপ্ন আর প্রত্যাশা নিয়ে বাংলাদেশের মানুষ দুই নেত্রীর পেছনে দাঁড়িয়েছিল। দুই নেত্রীর পেছনে দাঁড়িয়েই সেলিম, দেলোয়ার, জাফর, জয়নাল, দীপালি, তাজুল, জেহাদ, রাউফুন বসুনিয়া, ডা. মিলনসহ অনেক মানুষ প্রাণ দিয়েছিলেন। নূর হোসেন ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ স্লোগান বুকে-পিঠে লিখে গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন। প্রায় এক দশকের স্বৈরশাসক এরশাদের বিরুদ্ধে জীবনবাজি আন্দোলন করে অন্তত এরশাদের আমল থেকে ভালো থাকার অধিকার বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের রয়েছে। কতটা ভালো আমরা এখন আছি—এই আলোচনায় তাই এরশাদের আমলের সঙ্গে তুলনা হতে পারে।
এই তুলনায় পরিপ্রেক্ষিত তৈরি হয় ২৬ ডিসেম্বর গণতন্ত্র রক্ষায় ব্যর্থতার দায় দুই নেত্রীরই কি না, এ বিষয়ে জাতীয় প্রেসক্লাবে অনুষ্ঠিত একটি আলোচনা সভায়। এই অনুষ্ঠানে ঠিক আমার আগে বক্তব্য দেন এরশাদবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম নেতা ডাকসুর সাবেক ভিপি মাহমুদুর রহমান মান্না। তিনি আলোচনার একপর্যায়ে দুঃখ ও ক্ষোভ নিয়ে বলেন যে স্বৈরশাসক এরশাদের আমলে দুবার ডাকসু নির্বাচন হয়েছে, অথচ দুই নেত্রীর ২০ বছরের আমলে একবারও ডাকসু নির্বাচন দেওয়া হয়নি। মান্নার এই বক্তব্যের গভীর তাৎপর্য রয়েছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে সুস্থ ধারায় রাজনীতির বিকাশ, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, অসাম্প্রদায়িক ও মুক্তবুদ্ধির চেতনা সম্প্রসারণে ডাকসু ও নির্বাচিত ছাত্র সংসদগুলোর বিশাল ভূমিকা রয়েছে। কেন তাহলে দুই নেত্রীর আমলে কোনো ছাত্র সংসদের নির্বাচন হচ্ছে না? তার অনুমিত কারণ হচ্ছে, দুই নেত্রী রাজনৈতিকভাবে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে পারেন, এ রকম কোনো প্রতিষ্ঠান রাখতে চান না। নির্বাচিত ছাত্রনেতৃত্বের চেয়ে নিজের নির্ধারিত অনুগত ছাত্রনেতৃত্ব রাখতেই তাঁরা বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। না হলে স্বৈরশাসকের আমলে ছাত্র সংসদের নির্বাচন হলে গণতান্ত্রিক আমলে কেন হবে না?
এই দুঃখবোধ থেকে আমার কোনো ভুল হলে প্রবীণ সাংবাদিক এবিএম মূসা ও সৈয়দ আবুল মকসুদকে তা শুদ্ধ করে দেওয়ার অনুরোধ করে আমি নিজেও উল্লিখিত আলোচনা সভায় ডাকসু নির্বাচনের প্রসঙ্গ তুলি। একই সঙ্গে আরও কিছু প্রশ্ন তুলি। আমার প্রশ্ন ছিল: খালেদা জিয়ার আমলে ক্রসফায়ার আর হাসিনার আমলের গুমের বিস্তার কি এরশাদের আমলে ছিল? এরশাদের আমলের তুলনায় দুই নেত্রীর আমলে কি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো বেশি কার্যকরভাবে কাজ করতে পারছে? এরশাদের আমলের তুলনায় কি রাজনৈতিক বিরুদ্ধতাবাদীরা কম সংখ্যায় মারা যাচ্ছেন? এসব প্রশ্ন তুলতে তুলতে ক্ষুব্ধ হয়ে আমি বলি: ‘এরশাদের চেয়েও দুই নেত্রী খারাপ, দুঃখের সঙ্গেই এটা বলছি’ (কিছু সংবাদমাধ্যমে ‘দুঃখের সঙ্গেই এটা বলছি’ এই শব্দগুলো উল্লেখ করা হয়নি)।
আমার এই আলোচনা তাই ব্যক্তি হাসিনা-খালেদা বা এরশাদকেন্দ্রিক ছিল না, ছিল তাঁদের আমলকেন্দ্রিক। সেটি করতে গিয়ে আমি সরলীকরণ করে বলেছি, এরশাদের তুলনায় দুই নেত্রী খারাপ। আমার এভাবে বলা উচিত হয়নি। যেহেতু আমি মাত্র কয়েকটি ক্ষেত্রে বিভিন্ন আমলের কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন তুলেছি। আমার তাই বলা উচিত ছিল: কিছু কিছু ক্ষেত্রে এরশাদের আমলের চেয়েও দুই নেত্রীর আমল খারাপ। আমার এই বক্তব্যও ভুল হতে পারে। কিন্তু দুর্নীতি, দলীয়করণ, রাজনৈতিক সন্ত্রাস, ক্ষমতার অতিকেন্দ্রীকরণ—এসব ক্ষেত্রে স্বৈরশাসক এরশাদের আমল থেকে গণতান্ত্রিক আমলে আরও ভালো থাকার প্রত্যাশা ব্যক্ত করা বা আরও ভালো আছি কি না, এই প্রশ্ন তোলা সম্ভবত অন্যায় নয়।
শুধু দুর্নীতির উদাহরণ দিই। এরশাদ নিজেই দুর্নীতিবাজ ছিলেন, তিনিই দুর্নীতি প্রাতিষ্ঠানিক করেছিলেন। কিন্তু এ কথা অস্বীকার করার কি উপায় আছে যে, দুই নেত্রীর আমলেই আমরা দুর্নীতিতে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গ্লানি ও লজ্জা ভোগ করেছি? দুই নেত্রীর আমলে উচিত ছিল এরশাদের প্রতিষ্ঠিত দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিক ভিতকে আঘাত করা, দুর্নীতির প্রকোপ হ্রাস করা। তাঁদের আমলে কি তা হয়েছে? দলীয়করণ, সন্ত্রাস আর ক্ষমতার অতিকেন্দ্রীকরণের ক্ষেত্রেও আমরা কি প্রত্যাশিত সাফল্য পেয়েছি তাঁদের আমলে?
তাই বলে কি অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল বা স্বৈরশাসন ভালো দেশের জন্য? প্রশ্নই আসে না। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, খারাপ গণতন্ত্রও এ ধরনের শাসনের চেয়ে সার্বিকভাবে অনেক ভালো। গণতন্ত্র গণমানুষের ভোটে প্রতিষ্ঠিত সরকার। শুধু এই বিবেচনাতেই গণতন্ত্র সারা বিশ্বে শ্রেষ্ঠ সরকারব্যবস্থা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। আর বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামের অন্যতম মূল আকাঙ্ক্ষাই ছিল গণতান্ত্রিক শাসন ও রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা। এটি সম্ভব গণতন্ত্রের চর্চার মাধ্যমেই। বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এবং গণতন্ত্রকে সমর্থন করা জাতি হিসেবে আমাদের সবচেয়ে প্রধান দায়িত্বের একটি।
কিন্তু আমি এও বিশ্বাস করি, গণতন্ত্রের আমলে জনকল্যাণমূলক অর্থনীতি, সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেওয়ার দায়িত্ব তুলনামূলকভাবে বেশি। গণতন্ত্রের আমলে গণতন্ত্রের ভিত শক্ত করা (যেমন: সংসদ কার্যকর করা, দলের ভেতরে গণতন্ত্র চর্চা, বিভিন্ন জবাবদিহিমূলক প্রতিষ্ঠানকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেওয়া, বিরুদ্ধ মতের প্রতি সহিষ্ণুতা), সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা (যেমন: চাকরি, ব্যবসা, মানবাধিকার ভোগ এবং প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণ) এবং অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠা করা (যেমন: দুর্নীতি দূর করা, সামাজিক নিরাপত্তাবলয় তৈরি করা, ব্যাপক কর্মসংস্থান, ন্যূনতম মজুরি, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, ধনীদের কর বৃদ্ধি) গেলে দেশে অরাজনৈতিক শক্তির হুমকি অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে যায়। আমরা তাই প্রত্যাশা করি। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এসব ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক আমলের সাফল্য যথেষ্ট কি? যদি যথেষ্ট না হয়, তাহলে গণতন্ত্রের স্বার্থে এসব বিষয়ে গঠনমূলক সমালোচনা সম্ভবত অসমীচীন নয়। প্রধানত বাংলাদেশে ঃগণতান্ত্রিক শক্তিগুলোর হানাহানি বা তাদের দুর্বলতার কারণেই অতীতে অরাজনৈতিক শক্তি ক্ষমতা দখলের অশুভ দুঃসাহস দেখাতে পেরেছে, এই হানাহানি বা দুর্বলতার সমালোচনার কারণে নয়।
প্রেসক্লাবে উল্লিখিত আলোচনায় আমি একই সঙ্গে বিভিন্ন আমলে নাগরিক সমাজের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তুলে বলি: এরশাদের আমলে দেশে কবিতা, শিল্প-সংস্কৃতি আর সাংবাদিকতার যে স্বর্ণযুগ ছিল, তাও কি আছে এখন আমাদের মধ্যে? একজন সম্মানিত আলোচক এ বিষয়ে প্রশ্ন তুললে আমি আলোচনা সভাস্থলেই ব্যাখ্যা করে বলি, এরশাদের আমলে এরশাদের বিরুদ্ধে কবি, সাংবাদিক, শিক্ষক, সাংস্কৃতিক কর্মীসহ সব গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল শক্তি ঐক্যবদ্ধ ছিল। এরশাদের আমলে গণতন্ত্রের পক্ষে অসাধারণ সব কবিতা, শিল্পকর্ম, সাংবাদিকতা হয়েছে। আমি বলেছিলাম যে এরশাদের পতনের পর সাংবাদিক, শিক্ষক, সাংস্কৃৃতিক কর্মী—সবাই দুই নেত্রীর বিভাজনে বিভাজিত হয়েছি, এই বিভাজন দেশের গণতন্ত্র সংহতকরণে আমাদের শক্তিকেও বিভাজিত করেছে। আমি এটিকে মোটেও এরশাদের কৃতিত্ব হিসেবে বর্ণনা করিনি, আমাদের ব্যর্থতা হিসেবে বলেছি।
প্রেসক্লাবে আলোচনায় আমি শব্দচয়নে একটি মারাত্মক ভুল করি। অনুষ্ঠানের সিডির রেকর্ড অনুসারে আমি প্রেসক্লাবে বলেছিলাম যে ‘এরশাদের আমলে ট্রাক দুর্ঘটনা ঘটেছিল, কয়েকজন ছাত্র নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছিল, আমরা তার বিরুদ্ধে অত্যন্ত সোচ্চার হয়েছিলাম।’ কিছু সংবাদমাধ্যমে শুধু ট্রাক দুর্ঘটনা কথাটি এসেছে, আমরা সবাই যে এ জন্য এরশাদের বিরুদ্ধে ‘অত্যন্ত সোচ্চার’ হয়েছিলাম, কথাটি উল্লেখ করা হয়নি। উল্লেখ করা হলে হয়তো বোঝা যেত যে আমি এটিকে ন্যক্কারজনক হত্যাকাণ্ডই বোঝাতে চেয়েছিলাম। ১৯৮৪ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারির এরশাদের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে ছাত্র মিছিলে ট্রাক তুলে দিয়ে এরশাদ সরকার সেলিম ও দেলোয়ারকে হত্যা করেছিল। এটি দুর্ঘটনা ছিল না, এটি ছিল নির্মম হত্যাকাণ্ড।
দুই নেত্রী এখন এসব হত্যাকাণ্ডের চেয়ে অনেক বেশি করে বলেন বা তাদের বলতে হয় একে অপরের আমলের হত্যাকাণ্ডের ব্যাপকতার কথা। আমরা কি দুই নেত্রীর কাছে এরশাদের আমলের হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু বিচার পেয়েছি? খুবই দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, সেলিম, দেলোয়ার, নূর হোসেন, বসুনিয়ারা যে স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে জীবন দিয়েছেন, তাকে মিত্র হিসেবে পাওয়ার জন্য বরং রীতিমতো প্রতিযোগিতায় লিপ্ত থাকেন আমাদের দুই গণতান্ত্রিক নেত্রী। এখনো তাঁরা তাই করছেন সম্ভবত। আর পতিত স্বৈরশাসক এরশাদ গর্বের সঙ্গে বলার সুযোগ পান যে দুই নেত্রী তার চেয়েও স্বৈরশাসক! আমরা কি দুই দলকে এর প্রতিবাদ করতে দেখেছি যথেষ্টভাবে?
দুই নেত্রীর কাছে প্রত্যাশা রইল যে তাঁদের শাসনামল যেন এতটাই উজ্জ্বল থাকে, যাতে কোনো স্বৈরশাসক এ ধরনের কথা বলার সুযোগই না পায় কখনো আর। প্রত্যাশা রইল বাংলাদেশে গণতন্ত্রের জয়যাত্রা যেন হয় তাঁদের হাতেই। শিক্ষা, সংস্কৃতি, প্রযুক্তি, বৈদেশিক বিনিয়োগ আর বেসরকারি খাতে বিকাশের বহু সাফল্য রচিত হয়েছে তাঁদের আমলে, অনেক ক্ষেত্রে তাঁদের সরকারের কৃতিত্বে। বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক চেতনার বিকাশ ঘটানোর ক্ষেত্রে এবং সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রেও তাঁদের বিশাল কৃতিত্ব রয়েছে। আমরা চাই, সুশাসনের অন্য মানদণ্ডেও (দুর্নীতি, দলীয়করণ ও সন্ত্রাস রোধ, প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণ, দলের ভেতরে গণতন্ত্র চর্চা) যেন তাঁরা বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যান আরও বহুদূর!
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।