নির্বাচনের এক বছর আগে দলে কাউকে স্থান দেয়ার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বনের জন্য নেতা-কর্মীদের পরামর্শ দিয়েছেন শেখ হাসিনা।
শনিবার আওয়ামী লীগের জাতীয় কাউন্সিল উদ্বোধন করে তিনি বলেন, “এখন যেহেতু ক্ষমতায় আছি। এখন অনেকে আছে, যারা ‘সরকারি দল’। এরা খোলস বদলে বদনাম করবে। এদের দলে স্থান দেবেন না। আমি সব সময় আপনাদের বলেছি।”
সকাল সাড়ে ১১টায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আওয়ামী লীগের ১৯তম সম্মেলন উদ্বোধন করেন দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা।
শান্তি, গণতন্ত্র, উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির লক্ষ্যে দেশকে এগিয়ে নেয়ার স্লোগান নিয়ে ৬৩ বছরের এই দলের ১৯তম জাতীয় সম্মেলন শুরু হয়েছে।
শেখ হাসিনা বলেন, “এই সম্মেলন শুধু নিময় রক্ষার নয়। এই সম্মেলনের মাধ্যমে সংগঠনকে শক্তিশালী করতে হবে, এগিয়ে নিতে হবে এবং নতুন নেতৃত্ব সৃষ্টি করতে হবে।”
সম্মেলনে বক্তব্যে যুদ্ধাপরাধের বিচার শেষ করার প্রত্যয় জানানোর পাশাপাশি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকারও করেন প্রধানমন্ত্রী।
মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী এই দলের সব পর্যায়ের নেতাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, “অনেক ঝড়-ঝাপটা এসেছে, পাড় ভেঙেছে। তারপরও আপনাদের সহযোগিতায় আওয়ামী লীগ এখন বাংলাদেশের সবচেয়ে সুসংগঠিত দল।”
যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিষয়ে তিনি বলেন, “আমি একটি কথা স্পষ্ট বলতে চাই। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা রক্ত দিয়ে বাংলাদেশের মাটিকে স্বাধীন করেছে। এই দেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবেই। যারা তাদের বাঁচাতে চান- তাদের বলব, এই চিন্তা থেকে দূরে সরে যান “
“যারা স্বাধীনতাবিরোধীদের হাতে পতাকা তুলে দেয়, তারা এদেশের কল্যাণ চায় না। এদের সম্পর্কে সজাগ থাকতে হবে।”
সম্মেলন উদ্বোধনের পর চার ধর্মের বাণী পাঠের আগে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বলেন, “আমাদের সরকারের লক্ষ্য অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ে তোলা।”
উদ্বোধন অনুষ্ঠানে সম্মেলনকে কেন্দ্র করে লেখা একটি গান বাংলা ছাড়াও ১০টি নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর ভাষায় গাওয়া হয়, তার সঙ্গে ছিল নাচও।
আগামী নির্বাচনের আগে সব ধরনের ষড়যন্ত্র থেকে সজাগ থাকতে দলীয় নেতাদের পরামর্শ দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, “অনেকের ক্ষমতায় যাওয়ার খায়েশ আছে। কিন্তু, জনগণের সামনা-সামনি দাঁড়ানোর সাহস নেই।
“তারা অলিগলি চোড়া গলি দিয়ে ক্ষমতায় আসতে চায়। তারাই জনগণকে বিভ্রান্ত করে। তারা জনগণের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলে “
জনগণ আওয়ামী লীগের ওপর আস্থাশীল দাবি করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমাদের লক্ষ্য গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো যেন কাজ করতে পারে। আমরা দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করেছি। গণতন্ত্র সুসংহত করতে এবং মানুষের অধিকার নিশ্চিত করতে আমরা কাজ করে যাচ্ছি।
“বাংলাদেশের ইতিহাসে এরকম রেকর্ড নেই যে একটা সরকার ক্ষমতায় থাকে আর মন্ত্রীকে ডেকে দুর্নীতি দমন কমিশন জিজ্ঞাসাবাদ করে। আমরা দুর্নীতি দমন কমিশনকে সে স্বাধীনতা দিয়েছি।”
বর্তমান সরকারের সময়ে কোনো ধরনের নির্বাচনে সরকারি হস্তক্ষেপ হয়নি জানিয়ে শেখ হাসিনা আগামী নির্বাচনের বিষয়ে বলেন, “জনগণের যদি ভালো লাগে তাহলে ভোট দেবে। নাহলে, যে রায় দেবে, তা মাথা পেতে নেব।”
উদ্বোধনী বক্তব্যে আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ও সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ চার নেতাকে স্মরণ করেন তিনি।
নৌকার আদলে তৈরি মঞ্চের সামনের দু’দিকে ছিল বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার প্রতিকৃতি।
মঞ্চের সামনের বাইরের দিকে বাম দিকে ছিল জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমেদ, এম মনসুর আলী ও এ এইচ এম কামরুজ্জামানের প্রতিকৃতি।
ডান দিকে ছিল আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাকালীন নেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, হাসান শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ ও শামসুল হকের প্রতিকৃতি।
সম্মেলন মঞ্চের ব্যানারে ‘শান্তি, গণতন্ত্র, উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির লক্ষ্যে দেশকে এগিয়ে নেয়ার’ স্লোগানটি ফুটিয়ে তোলা হয় জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সংসদের পটভূমিতে।
মঞ্চে শেখ হাসিনাসহ কেন্দ্রীয় নেতাদের আসনের পেছনে এবং ব্যনারের সামনেই ছিল ডিজিটাল পর্দা, তাতে সরকারের গত চার বছরের সাফল্যগুলো তুলে ধরা হয়।
জাতীয় সঙ্গীতের সঙ্গে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলনের পর পায়রা উড়িয়ে সম্মেলন উদ্বোধন করেন শেখ হাসিনা।
দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন, দলীয় পতাকা উত্তোলন করেন দলের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম।
প্রধানমন্ত্রী যখন পায়রা ওড়ান, তখন বাজছিল ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’ গানটি। এরপর ‘শোনো একটি মুজিবুরের থেকে’, ‘বিজয় নিশান উড়ছে ওই’ গান দুটি পরিবেশিত হয়।
উদ্বোধন অনুষ্ঠানে চার ধর্মীয় গ্রন্থ থেকে পাঠের পর শোক প্রস্তাব উত্থাপন করেন দলের সাংগঠনিক সম্পাদক ও স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী আব্দুল মান্নান খান।
এরপর সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফের পর সভাপতির বক্তব্য রাখেন শেখ হাসিনা।
শেখ হাসিনার বক্তব্যের মধ্য দিয়ে শেষ হয় উদ্বোধন অধিবেশন। এরপর বিকাল ৩টা থেকে কাউন্সিল অধিবেশন শুরু হবে। কাউন্সিল শেষ হবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে।
সাজেদা চৌধুরী তার বক্তব্যে দলীয় নেতাদের যে কোনো পরিস্থিতিতে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহবান জানান।
সাধারণ সম্পাদকের প্রতিবেদনে সৈয়দ আশরাফ বলেন, “মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারীদের বিচার এই বাংলার মাটিতেই করব।
“বাংলাদেশের ইতিহাস আওয়ামী লীগের ইতিহাস। বাংলাদেশের যা অর্জন, তা আওয়ামী লীগের হাত ধরেই। আজকের এই কাউন্সিল হবে ইতিহাসের অংশ “
সরকারের আগামী এক বছরে নির্বাচনী সব প্রতিশ্রুতি একে একে বাস্তবায়ন হবে বলে কাউন্সিলরদের আশ্বস্ত করেন স্থানীয় সরকারমন্ত্রী আশরাফ।
“আওয়ামী লীগ কখনোই জনগণকে ধোঁকা দেয় না। আমরা ক্ষমতায় এসে সংবিধান সংশোধন করি। বাংলার মাটিতে অবৈধ অস্ত্রের জোরে ক্ষমতা দখলের কোনো অবস্থান নেই।”
আগামী নির্বাচনে পুনরায় জিততে দলকে শক্তিশালী করার আহ্বান জানিয়ে আগামী দু’মাসের মধ্যে সব জেলায় সম্মেলন করার তাগিদ দেন তিনি।
সম্মেলন মঞ্চে শেখ হাসিনার সঙ্গে ছিলেন দলের কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্যরা। মঞ্চের সামনে অতিথি সারিতে আমন্ত্রিত বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা এবং কূটনীতিকরা বসেন।
রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে ছিলেন জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু, ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দীলিপ বড়ুয়া, সিপিবির কেন্দ্রীয় নেতা রুহিন হোসেন প্রিন্সকে।
আব্দুল জলিলসহ উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যরা ছিলেন দর্শক সারিতে। জরুরি অবস্থার সময় সংস্কারপন্থী বলে পরিচিতি পাওয়া আ খ ম জাহাঙ্গীরকেও দর্শক সারিতে দেখা গেছে।
বিকাল শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে কাউন্সিল অধিবেশন শুরুর পর প্রথমে সাত বিভাগের সাংগঠনিক প্রতিবেদন পেশ করা হবে।
এরপর ঘোষণাপত্র ও গঠনতন্ত্রের সংশোধন উত্থাপন ও অনুমোদন করা হবে। নির্বাচন কমিশনের নাম প্রস্তাব ও অনুমোদনের পর বর্তমান কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করা হবে।
শেখ হাসিনাসহ নেতৃবৃন্দ মঞ্চ থেকে নেমে আসন গ্রহণ করার পর নির্বাচন কমিশন আসন গ্রহণ করে নতুন কমিটি গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করবেন।
আওয়ামী লীগের সর্বশেষ সম্মেলন হয় ২০০৯ সালের ২৪ জুলাই। সেই সম্মেলনে আব্দুল জলিলের বদলে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম।
এবারের সম্মেলনে সারা দেশ থেকে যোগ দেবেন ৬ হাজার ৩০০ কাউন্সিলর।
আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রের ছয় ধারার ‘খ’ উপ-ধারায় ২৫ হাজার জনসংখ্যার জন্য একজন কাউন্সিলর থাকার কথা বলা হয়েছে। সে হিসাবে আওয়ামী লীগের ৭৩টি সাংগঠনিক জেলা থেকে ছয় হাজার ৩০০ জন কাউন্সিলর সম্মেলনে যোগ দেবেন বলে জানান আওয়ামী লীগের উপ-দপ্তর সম্পাদক মৃনাল কান্তি দাস।
ডেলিগেট ও কাউন্সিলরসহ প্রায় ২০ হাজার নেতাকর্মী এবারের সম্মেলনে উপস্থিত থাকবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
সম্মেলন সফল করতে অভ্যর্থনা, প্রচার, গঠনতন্ত্র সংশোধনসহ আওয়ামী লীগের ১০টি উপ-কমিটি গঠন করা হয়েছে। আড়াই হাজার স্বেচ্ছাসেবক ১১০টি দলে ভাগ হয়ে সম্মেলনে দায়িত্ব পালন করছেন।
১৯৪৯ সালের ২৩ জুন পুরান ঢাকার কে এম দাস লেনের রোজ গার্ডেনে আত্মপ্রকাশ ঘটে আওয়ামী লীগের, যে দলের নেতৃত্বে প্রায় দুই যুগ পর স্বাধীন হয় বাংলাদেশ।
মুসলিম লীগের প্রগতিশীল একটি অংশের উদ্যোগে বাঙালি জাতির মুক্তির লক্ষ্যে গঠিত হয়েছিল ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’।
প্রতিষ্ঠাকালে মওলানা ভাসানী দলটির সভাপতি, শামসুল হক সাধারণ সম্পাদক এবং কারাবন্দি শেখ মুজিবুর রহমান যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন।
আওয়ামী মুসলিম লীগ নামে যাত্রা শুরু করলেও অসাম্প্রদায়িক চেতনায় ১৯৫৫ সালে কাউন্সিলে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দেয়া হয়। নতুন নাম হয়-‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ’। স্বাধীনতার পর ‘বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ’ নাম নেয় দলটি।
প্রতিষ্ঠার পর থেকে রাজনৈতিক সংগ্রাম, যুক্তফ্রন্ট গঠন ও ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে বিজয়সহ বিভিন্ন ঘটনার মধ্য দিয়ে ৫০ এর দশকেই আওয়ামী লীগ হয়ে ওঠে পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান রাজনৈতিক শক্তি।
তবে প্রতিষ্ঠাকালীন সভাপতি আব্দুল হামিদ খান ভাসানী রাজনৈতিক মতভিন্নতার জন্য ১৯৫৭ সালে দল ছেড়ে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গঠন করেন।
এরপর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে দীর্ঘসময় দলটি সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন করে জনগণের মধ্যে আস্থা তৈরি করে। ১৯৬৬ সালে ছয় দফা দেন বঙ্গবন্ধু, যাকে বাঙালির মুক্তির সনদ নামে অভিহিত করা হয়। ছয় দফার ভিত্তিতেই ৭০ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে।
এরপর পাকিস্তানি বাহিনী আক্রমণ শুরু করলে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বেই শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর অভ্যুদয় ঘটে বাংলাদেশের।
১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর সামরিক শাসনে নির্যাতন আর নিপীড়নের মধ্যে পড়ে ঐতিহ্যবাহী এই সংগঠন, নেতাদের মধ্যেও দেখা দেয় বিভেদ।
১৯৮১ সালের ১৭ মে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা দলীয় সভাপতি হিসাবে দেশে ফিরে কয়েকভাগে বিভক্ত আওয়ামী লীগকে ঐক্যবদ্ধ করেন, আন্দোলন শুরু করেন সামরিক শাসক এইচ এম এরশাদের বিরুদ্ধে।
২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে নির্বাচনে জয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ আবারো সরকার গঠন করে। পাঁচ বছর শাসনের পর ২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পরাজিত হয়। কিন্তু দলটির পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়, কারচুপির মাধ্যমে তাদের হারানো হয়েছে।
এরপর দেশে রাজনৈতিক সঙ্কটের পর ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিপুলভাবে জয়ী হয়ে পুনরায় সরকারে ফেরে।