টিআইবির খানা জরিপ: ‘সেবা খাতের এক বছরের দুর্নীতির টাকা দিয়ে পদ্মা সেতু তৈরি সম্ভব’

টিআইবির খানা জরিপ: ‘সেবা খাতের এক বছরের দুর্নীতির টাকা দিয়ে পদ্মা সেতু তৈরি সম্ভব’

সেবা খাতে ১ বছরে দুর্নীতি হয়েছে ২১ হাজার ৯৫৫ কোটি ৬০ লাখ টাকা। যা ২০১১-২০১২ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটের ১৩ দশমিক ৬ ভাগ। জিডিপির হিসেবে তা ২ দশমিক ৪ ভাগ। টাকার অংকে এ দুর্নীতি ২০১০ সালের তুলনায় দ্বিগুণ। তবে টিআইবি জানিয়েছে, ১৩টি সুনির্দিষ্ট সেবাখাতের দুর্নীতির সার্বিক পরিস্থিতি ২০১০ সালে ছিল ৮৪ দশমিক ২ শতাংশ। এবার হ্রাস পেয়ে তা হয়েছে  ৫৫ দশমিক ৮ শতাংশ।  সেবা খাতগুলোর মধ্যে এবার সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি হয়েছে শ্রম অভিবাসন খাতে। এ খাতে শতকরা ৭৭ ভাগ দুর্নীতি হয়েছে। এর পরেই রয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকরী বাহিনী। আইনশৃঙ্খলা রক্ষা
সংস্থাগুলোতে ৭৫ দশমিক ৮ ভাগ দুর্নীতি হয়েছে। এর পরেই যেসব খাত রয়েছে সেসবের মধ্যে রয়েছে- ভূমি প্রশাসন, বিচার ব্যবস্থা, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান, কৃষি, বিদ্যুৎ, কর ও শুল্ক, ব্যাংকিং, বীমা, এনজিও এবং অন্যান্য খাত। শুক্রবার সকালে রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) জাতীয় খানা জরিপ ২০১২ এর ফল প্রকাশ করে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান। সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়েছে- জরিপকৃত বছরে উল্লেখযোগ্যহারে কমেছে সেবা গ্রহীতার হার। কেবল সেবা খাতের এক বছরের দুর্নীতির টাকা দিযেই পদ্মা সেতু তৈরি সম্ভব। এছাড়া ঘুষ দেয়ার প্রবণতা আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে বলে জানানো হয়েছে। ২০১২ সালের জাতীয় খানা জরিপ অনুযায়ী- শ্রম অভিবাসন এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা ছাড়াও ভূমি প্রশাসন খাতে ৫৯ ভাগ, বিচারিক সেবা খাতে ৫৭ দশমিক ১ ভাগ দুর্নীতি হচ্ছে। স্বাস্থ্যখাতে ৪০ দশমিক ২, শিক্ষাখাতে ৪০ দশমিক ১ এবং স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে দুর্নীতির শিকার হওয়ার হার ৩০ দশমিক ৯ ভাগ। কৃষিতে ২০ দশমিক ৪, বিদ্যুৎ-খাতে ১৮ দশমিক ৩, কর ও শুল্ক খাতে ১৬ দশমিক ৮, ব্যাকিং সেবায় ৭ দশমিক ১, বীমা খাতে ৬, এনজিও খাতে ৫ এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে (বিআরটিএ, ওয়াসা, পাসপোর্ট, বিটিসিএল, ডাক ও নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি) দুর্নীতির শিকার হওয়ার হার ৪১ দশমিক ১ ভাগ।
সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন টিআইবি ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারপারসন এডভোকেট সুলতানা কামাল এবং নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান। গবেষণা প্রতিবেদন পাঠ করেন সংস্থাটির পরিচালক রফিকুল হাসান এবং সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার শাহজাদা আকরাম। সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়েছে- সার্বিকভাবে দেশের ৬৩ দশমিক ৭ ভাগ সেবাগ্রহণকারী কোন না কোনভাবে দুর্নীতির শিকার হচ্ছেন। বলা হয়েছে- সেবা গ্রহণের সময় বাংলাদেশের ৫৩ দশমিক ৩ ভাগ খানাকে (একক পরিবার) কোন না কোন খাতে নিয়ম-বহির্ভূত অর্থ দিতে হয়েছে। এর গড় ১৩ হাজার ৮৪ টাকা। জরিপকৃত সব খানার জন্য নিয়ম-বহির্ভূত এ অর্থের গড় ৬ হাজার ৯০০ টাকা।
এডভোকেট সুলতানা কামাল বলেন, যখন সেবা গ্রহণের হার উল্লেখযোগ্য হারে কম হয় তখন এটি প্রতীয়মান হয় যে, আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলো এখনও যথেষ্ঠ মাত্রায় সেবামুখী ও শক্তিশালী হয়ে ওঠেনি। এর ফলে জনসাধারণের মধ্যে প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়। তারা নানা বিকল্প উপায়ে সেবা নিতে গিয়ে দুর্নীতির শিকার হন। এতে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়। ক্ষমতার অপব্যবহারের সুযোগ তৈরি হয়। যা মূলত সুশাসনকে বাধাগ্রস্ত করে।
ইফতেখারুআমন বলেন, ২০১০ এর জাতীয় খানা জরিপের সঙ্গে ২০১২ সালের তুলনামূলক চিত্রের বিশ্লেষণে দেখা যায়- আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা, ভূমি প্রশাসন, বিচারিক সেবা, কৃষি, বিদ্যুৎ, কর ও শুল্ক, শিক্ষা, ব্যাংকিং, বীমা এবং এনজিও খাতে আগের তুলনায় দুর্নীতির হার কমলেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা, ভূমি প্রশাসন, বিচারিক সেবা, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের মতো খাতে দুর্নীতির ফলে মানুষ হয়রানির শিকার হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। স্বাস্থ্যখাতে ২০১০ সালে দুর্নীতি ছিল ৩৩ দশমিক ২ শতাংশ। এবার তা থেকে বেড়ে ৪০ দশমিক ২ ভাগ হয়েছে। অন্যান্য ক্ষেত্রে ২০১০ সারে দুর্নীতি ছিল ৩৪ দশমিক ১ ভাগ। এবার দুর্নীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৪ দশমিক ৯ ভাগ।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভৌগোলিক অবস্থানভেদে দুর্নীতির মাত্রা গ্রামাঞ্চলে বেশি। নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠীর জন্য দুর্নীতির প্রভাব তুলনামূলকভাবে বেশি (মোট ব্যয়ের ৫ দশমিক ৫ ভাগ)। ধনীদের জন্যে তা তুলনামূলক কম ( মোট ব্যয়ের ১ দশমিক ৩ ভাগ)। দুর্নীতির কারণে বিপুল ক্ষতির বোঝা আপেক্ষিক অর্থে দরিদ্র জনগণের ওপরেই বেশি। দুর্নীতির ব্যাপকতা রোধে গবেষণা প্রতিবেদনে বেশকিছু সুপারিশ বাস্তবায়নের দাবি জানানো হয়েছে। এসবের মধ্যে রয়েছে- তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি, প্রণোদনা প্রদান, দুর্নীতির বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণ ও দক্ষতা বৃদ্ধি, তথ্য অধিকার আইন ২০০৯ ও তথ্য প্রকাশকারীর সুরক্ষা আইন ২০১১ এর কার্যকর বাস্তবায়ন, স্বাধীন ও শক্তিশালী দুদক গঠন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে জাতীয় সংসদ ও মন্ত্রণালয়ের তদারকি বৃদ্ধি, জাতিসংঘ দুর্নীতিবিরোধী সনদ বাস্তবায়ন, নাগরিক সমাজ প্রতিষ্ঠান ও গণমাধ্যমের ভূমিকা বৃদ্ধি ইত্যাদি।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়েছে- বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)-এর ইন্টিগ্রেটেড মাল্টিপারপাস স্যাম্পিং পদ্ধতি ব্যবহার করে এ জরিপটি পরিচালিত হয়েছে। গ্রামীণ এলাকায় ৬০ ভাগ এবং শহর এলাকায় ৪০ ভাগ নমুনা ধরে বিভিন্ন স্তরে খানা নির্বাচন করা হয়েছে। জরিপকৃত খানার সংখ্যা ৭৯০৬ টি। তার মধ্যে ইউনিয়ন পর্যায়ে ৪ হাজার ৬২৪টি, পৌরসভা পর্যায়ে ১ হাজার ৯৮১টি এবং স্টেটিসটিক্যাল মেট্রোপলিটন এলাকার (এসএমএ) খানা ছিল ১ হাজার ৩০১টি। খানাজরিপে তথ্যদাতার মধ্যে খানাপ্রধান ৬৬ দশমিক ৩ ভাগ, পরিবারের অন্যান্য সদস্য ৩৩ দশমিক৭ ভাগ, ৩৫ দশমিক ৮ ভাগ নারী এবং ৬৪ দশমিক ২ ভাগ ছিল পুরুষ।
উল্লেখ্য, ১৯৯৭ সাল থেকে টিআইবি এ পর্যন্ত ৬টি খানা জরিপ পরিচালনা করেছে। ২০১২ সালের জরিপে সেবা নেয়ার সময়কাল ২০১১ সালের মে থেকে ২০১২ সালের এপ্রিল পর্যন্ত। তথ্য সংগৃহীত হয়েছে ২০১২ সালের ১৫ই মে থেকে ৪ঠা জুলাই পর্যন্ত। জরিপের বৈজ্ঞানিক মান নিশ্চিতকল্পে কঠোর প্রশাসনিক পদক্ষেপের পাশাপাশি ছয়জন জাতীয়-আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিশেষজ্ঞের একটি দলের সহায়তা ও পরামর্শ গ্রহণ করা হয়েছে বলে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়েছে।

অন্যান্য বাংলাদেশ রাজনীতি শীর্ষ খবর