উপমহাদেশের প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের আজ ১৯তম জাতীয় সম্মেলন। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকার রোজ গার্ডেনে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে সভাপতি, টাঙ্গাইলের শামসুল হককে সাধারণ সম্পাদক ও শেখ মুজিবুর রহমানকে যুগ্ম সম্পাদক করে এই দলের যাত্রা। পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে দলটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। স্বাধিকার-স্বাধীনতার সংগ্রাম থেকে ‘৭০ সালের নির্বাচনে বিশাল জয় নিয়ে ‘৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেয় আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগ-বঙ্গবন্ধু আর বাংলাদেশের নামটি ইতিহাসে অবিচ্ছেদ্য হয়ে যায়। ‘৬৩ বছরের দীর্ঘ সংগ্রামের পথ পরিক্রমায় বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা দলের ঐক্যের প্রতীক হয়ে সর্বাধিক ৩১ বছর ধরে নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন। ১৯৫৩ (ময়মনসিংহের কাউন্সিলে) সালে সভাপতি নির্বাচিত হন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন শেখ মুজিবুর রহমান। এরপর একই সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত কাউন্সিলে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক তারাই পুনরায় নির্বাচিত হন। ১৯৫৪ সালের ১৪ নভেম্বর কাউন্সিল অধিবেশনে যুক্তফন্ট গঠন, ঐতিহাসিক ২১ দফা দাবি প্রণয়ন করা হয়। ১৯৫৪ সালের ৮ মার্চ পূর্ববাংলার প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনের ভেতর দিয়ে পূর্ববাংলা থেকে মুসলিম লীগের উচ্ছেদ ঘটনা আওয়ামী লীগের বিরাট সাফল্য। ওই নির্বাচনে ২৩৭টি আসনের মধ্যে যুক্তফন্ট পেয়েছিল ২২৩টি। এর মধ্যে ১৩৭টি আসন পেয়ে পূর্ববাংলার সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দলে পরিণত হয় আওয়ামী লীগ। ১৯৫৫ সালের ২১-২৩ অক্টোবর ঢাকার সদরঘাটের রূপমহল সিনেমা হলে দলের তৃতীয় কাউন্সিল অধিবেশনে আওয়ামী লীগ অসাম্প্রদায়িক সংগঠনে পরিণত হয়। দলের নতুন নামকরণ হয় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ। নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এ প্রস্তাবটি উত্থাপন করেন। পরে কাউন্সিল অধিবেশনে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বহাল থাকেন। ‘৫৭ সালে কাগমারী সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক নির্ণয়ে সোহরাওয়ার্দী-ভাসানীর মতপার্থক্যের কারণে প্রথমবারের মতো আওয়ামী লীগ ভেঙে যায়। ভাসানীর নেতৃত্বে গঠিত হয় ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) আর মূল দল আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ ও সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান অপরিবর্তিত থাকেন। ‘৫৮ সালে পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি হলে আওয়ামী লীগের কর্মকাণ্ড স্থগিত করা হয়। দীর্ঘ ছয় বছর ‘আন্ডারগ্রাউন্ড’ রাজনীতি করার পর ‘৬৪ সালে দলটির কর্মকাণ্ড পুনরুজ্জীবিত করা হয়। এতে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে তর্কবাগীশ-মুজিব অপরিবর্তিত থাকেন।
১৯৬৬ সালের কাউন্সিলে দলের সভাপতি পদে নির্বাচিত হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তার সঙ্গে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন তাজউদ্দীন আহমদ। এর পরে ‘৬৮ ও ‘৭০ সালের কাউন্সিলে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক অপরিবর্তিত থাকে। এই কমিটির মাধ্যমেই পরিচালিত হয় মহান মুক্তিযুদ্ধ। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রথম কাউন্সিলে সভাপতি হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন বর্তমান রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান। ‘৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু সভাপতির পদ ছেড়ে দিলে সভাপতির দায়িত্ব দেওয়া হয় এএইচএম কামরুজ্জামানকে। সাধারণ সম্পাদক পদে বহাল থাকেন জিল্লুর রহমান। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পট পরিবর্তনে আওয়ামী লীগের রাজনীতি আবারও স্থগিত করা হয়। এ সময় আওয়ামী লীগের অসংখ্য নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করে অমানবিক নির্যাতন চালানো হয়। ‘৭৬ সালে ঘরোয়া রাজনীতি চালু হলে আওয়ামী লীগকেও পুনরুজ্জীবিত করা হয়। এতে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক করা হয় মহিউদ্দিন আহমেদ ও বর্তমান সংসদের উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীকে। এ সময় একবার ভেঙে যায় আওয়ামী লীগ। ‘৭৭ সালে এই কমিটি ভেঙে করা হয় আহ্বায়ক কমিটি। এতে দলের আহ্বায়ক করা হয় সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীনকে। ‘৭৮ সালের কাউন্সিলে দলের সভাপতি করা হয় আবদুল মালেক উকিলকে এবং সাধারণ সম্পাদক হন আবদুর রাজ্জাক।
এর পরেই শুরু হয় আওয়ামী লীগের উত্থানপর্ব, উপমহাদেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল হিসেবে গড়ে তোলার মূল প্রক্রিয়া। সঠিক নেতৃত্বের অভাবে দলের মধ্যে সমস্যা দেখা দিলে নির্বাসনে থাকা বঙ্গবন্ধু কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। দেশে ফেরার আগেই ‘৮১ সালের কাউন্সিলে শেখ হাসিনাকে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী এবং সাধারণ সম্পাদক পদে বহাল থাকেন আবদুর রাজ্জাক। আবারও আঘাত আসে দলটির ওপর। ‘৮৩ সালে আবদুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে দলের একটি অংশ পদত্যাগ করে আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে বাকশাল গঠন করে। এ সময় সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীকে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ‘৮৭ সালের কাউন্সিলে শেখ হাসিনা সভানেত্রী ও সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী সাধারণ সম্পাদক হন।
‘৯২ ও ‘৯৭ সালের সম্মেলনে শেখ হাসিনা এবং জিল্লুর রহমান দলের সভানেত্রী ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ২০০০ সালের বিশেষ কাউন্সিলে একই কমিটি বহাল থাকে। ২০০২ সালের ২৬ ডিসেম্বর জাতীয় কাউন্সিলে শেখ হাসিনা সভানেত্রী এবং আবদুল জলিল সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ দেশের একক বৃহত্তম রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়। তিন-চতুর্থাংশেরও বেশি আসনে বিজয়ী হওয়ার পর সর্বশেষ ২০০৯ সালের ২৪ জুলাই আওয়ামী লীগের সর্বশেষ কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। শেখ হাসিনা সভানেত্রী পদে বহাল থাকেন এবং নতুন সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন বর্তমান এলজিআরডি মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। আর এই কাউন্সিলের মাধ্যমে তারুণ্যনির্ভর কেন্দ্রীয় কমিটি গড়ে তোলেন শেখ হাসিনা। এতে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব থেকে ছিটকে পড়েন দলের অধিকাংশ সিনিয়র ও অভিজ্ঞ নেতারা।