সৌদি আরবের শীর্ষস্থানীয় দৈনিক সৌদি গেজেটে বুধবার বাংলাদেশকে নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের বিশিষ্ট সাংবাদিক ও সমাজ-রাজনৈতিক বিশ্লেষক তারিক এ. আল-মাঈনার একটি বিশেষ প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। এতে মধ্যপ্রাচ্যের অধিবাসীদের বাংলাদেশ সম্পর্কে ভুল ধারণা নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করেন লেখক। বাংলানিউজের পাঠকদের জন্য প্রবন্ধটির সরাসরি অনুবাদ তুলে দেওয়া হল।
মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় শ্রমিক চাহিদা মেটাতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছেন লাখ লাখ বাংলাদেশি। এছাড়া দক্ষ ও অর্ধ-দক্ষ খাতেও কাজ করছেন দেশটির অনেক মানুষ।
তবে দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, মাঝে মাঝেই বাংলাদেশি শ্রমিকদের আমাদের পত্রিকার খবরে দেখা যায়। অনেক সময় সেটা হয় ভুল কারণে বা ভুল বোঝাবুঝির ফলে। তারা যে দেশের বাসিন্দা, সে দেশের প্রতি নেতিবাচক ধারণা ও অবিশ্বাস তৈরি হয় এতে। বিদেশ থেকে আগত শ্রমিকদের মধ্যে সবচেয়ে কম পারিশ্রমিকে কাজ করা সত্ত্বেও তাই তারা চিহ্নিত হয়ে গেছেন। যে বিশ লাখ শ্রমিক দক্ষিণ এশিয়ায় নিজেদের দেশ থেকে জীবিকার আশায় এখানে উড়ে এসেছেন, তাদের প্রতি এটা অবিচার।
আরও দুঃখজনক ব্যাপার হলো, আমাদের গণমাধ্যম কেবল অল্প কিছু বাংলাদেশির কুকর্মের কথাই ফলাই করে প্রচার করে। অথচ যে বিরাট গোষ্ঠী দিনরাত কঠোর পরিশ্রম করে জরুরী সেবা দিচ্ছে, তাদের অবদানের কোনো উল্লেখ করছে না। এর ফলে প্রবাসী ডাক্তার, প্রকৌশলী, শিক্ষক, অধ্যাপক, ব্যবসায়ী, কর্মকর্তা থেকে শুরু করে ড্রাইভার, সুইপার, দারোয়ান, কৃষক, শ্রমিক- সবার প্রতিই নেতিবাচক ধারণা তৈরি হচ্ছে।
বাংলাদেশের প্রবাসী শ্রমিকদের অনেকেই দাস বলে ভাবতে চান, কিন্তু এটাই সবচেয়ে বড় ভুল। এটা ঠিক যে ১৫ কোটি মানুষের ভার নিয়ে বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের মতোই বহির্বিশ্বে সুযোগ খুঁজছে। কিন্তু তাই বলে তাদের ভূমিকা ও মর্যাদাকে ছোট করে দেখার কোনো উপায় নেই।
গভীরভাবে দেখলে বাংলাদশের চিত্র আরও ভিন্ন। তারা ক্রমশ এগিয়ে যাচ্ছে। দেশটি ভ্রমণ করলে আমাদের অনেকেরই ভুল ধারণা ভেঙে যাবে। সেখানে গিয়ে বোঝার উপায় নেই যে এটি ১৫ কোটি মানুষের ভারে ন্যুব্জ একটি দেশ, যেখানকার মানুষ অন্য কোথাও যাবার জায়গা না পেয়ে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন।
২০২১ সালের মধ্যেই দেশটি মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। আর এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন মোটেই অসম্ভব নয়। ইতোমধ্যেই এমন কিছু সম্পদ রয়েছে তাদের, যা অনেক দেশের নেই। অত্যন্ত উর্বর জমির ফলে বাংলাদেশ আজ খাদ্যে পরিপূর্ণ, যেটা পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশেই দুর্লভ। বাংলাদেশিদের বড় বৈশিষ্ট্য, তারা অত্যন্ত কর্মঠ। সেখানকার শহর-গ্রামে গেলেই দেখা যায়, মানুষ জীবিকার জন্য কত কি করছে। এতো প্রাণশক্তি যাদের, তাদের লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছানো বেশি কঠিন নয়।
সীমানা পেরিয়ে বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক খ্যাতি এনে দিয়েছেন এখানকার অনেক কৃতি সন্তান। ২০০৬ সালে নোবেল পুরস্কার পাওয়া বাংলাদেশি অর্থনীতিবিদ ড. মুহম্মদ ইউনূসের ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্প এখন যুক্তরাষ্ট্রসহ ৬০টিরও বেশি দেশে অনুসরণ করা হয়।
শিকাগোর ১০০ তলা জন হ্যানকক সেন্টার ও ১১০তলা সিয়ার্স টাওয়ারের নকশা করেছিলেন বাংলাদেশি নির্মাণ প্রকৌশলী ফজলুর রহমান খান। ১৯৭৩ সালে নির্মিত এ ভবনগুলো সেসময় পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু ভবন ছিল। ১৯৯৮ সালে শিকাগো কর্তৃপক্ষ সিয়ার্স টাওয়ারের সামনের রাস্তাটির নাম পরিবর্তন করে ‘ফজলুর আর. খান ওয়ে’ রাখে।
হার্ভার্ড গ্র্যাজুয়েট বাংলাদেশি আইনজীবী আইরিন খান ২০০১ সালে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের প্রথম নারী সেক্রেটারি জেনারেল হিসেবে নির্বাচিত হন। একই সঙ্গে তিনি এ পদে নিয়োগপ্রাপ্ত প্রথম এশিয়ান। এখানে তিনি আট বছরেরও বেশি কর্মরত ছিলেন।
বাংলাদেশি ফ্যাশন ডিজাইন বিবি রাসেল দেশটির ফ্যাশন শিল্পকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। তার অধীনে বর্তমানে ৩৫ হাজারেরও বেশি বুননশিল্পী কাজ করছেন। তার পণ্যের সুনাম দেশ ছাড়িয়ে সারা বিশ্বে পৌঁছেছে।
এছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ খাতে অনেক বাংলাদেশি উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন। দেশটি নিজেও অর্থনীতিতে ক্রমাগত উন্নতি করছে। বস্ত্রশিল্পে ব্যাপক উন্নতির ফলে আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডগুলো তাদের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে। জাপান থেকে শুরু করে যুক্তরাষ্ট্রের অনেক বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে শাখা স্থাপন করছে।
বাংলাদেশকে নিয়ে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টানোর সময় এসেছে। দেশটি নিয়ে গবেষণায় আমি আমার পাঠকদের এটা অন্তত নিশ্চিত করে বলতে পারি, তাদের মধ্যে এমন একটা প্রাণবন্ততা আছে, যার ফলে তাদের পক্ষে সবকিছু করা সম্ভব। আর তাই, বাংলাদেশ দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে.. অবশ্যই উন্নতির দিকে।