তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু এমপি বলেছেন, মানবতাবিরোধী অপরাধীদের প্রত্যেককে একজন একজন করে খুঁজে বের করে বিচারের মুখোমুখি করা হবে। যুদ্ধাপরাধী আওয়ামী লীগ, জাসদ, জামায়াত যে দলেরই হোক না কেন, তাদের খুঁজে বের করে বিচারের আওতায় আনা হবে।
বুধবার সকালে তথ্য মন্ত্রণালয়ের সম্মেলনকক্ষে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন তথ্যমন্ত্রী। যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্তদের বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে জনগণের ধারণা স্বচ্ছ এবং সরকারের অবস্থান স্পষ্ট করতে সকাল সোয়া ১১টায় এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।
পরে তথ্যমন্ত্রী সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার রাজনৈতিক নয় উল্লেখ করে হাসানুল হক ইনু বলেন, ‘‘মোট চারটি কারণে এ বিচার করা হচ্ছে। সেগুলো হচ্ছে, বাংলাদেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, অপরাধীদের মাফ করে দেওয়ার সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসা, জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করা এবং মুক্তিযুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্তদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা।’’
তথ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘দু’টি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে চিহ্নিত ও আত্মস্বীকৃত মানবতাবিরোধী অপরাধী ও যুদ্ধাপরাধীদেরই বিচার করা হচ্ছে। এ বিচার প্রক্রিয়া বানচাল করতে বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে। বিভ্রান্তিমূলক তথ্য দেওয়া হচ্ছে। নানা ষড়যন্ত্র, হামলা, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়ে বিচার ভণ্ডুলে মরিয়া হয়ে উঠেছে যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্তদের রাজনৈতিক দল জামায়াত এবং তাদের সহযোগী দল, মহল ও ব্যক্তিরা।
কিন্তু সকল চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র নির্মূল করে জনগণের প্রাণের দাবি, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন হবেই বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
লিখিত বক্তব্যে বিচারাধীন বিষয় নিয়ে যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্তদের রাজনৈতিক দল জামায়াত এবং তাদের সহযোগী দল, মহল, ব্যক্তিদের নানা মিথ্যাচার, বিভ্রান্তি অপপ্রচার, বিচারের মানদণ্ড, স্কাইপিতে সংলাপসহ নানা বিষয়ে বিস্তারিত জানান হাসানুল হক ইনু।
তিনি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, সে সময় পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসরদের পরিচালিত হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতনসহ যুদ্ধাপরাধের বিভিন্ন ঘটনা, দালাল আইনে যুদ্ধাপরাধের বিচার, পরবর্তীকালে এই বিচার আটকে থাকা এবং বর্তমান সরকারের সময়ে নতুন করে বিচার প্রক্রিয়া শুরুর প্রেক্ষাপট ব্যাখ্যা করেন।
যুদ্ধারাধীদের ক্ষমা করার প্রসঙ্গে তথ্যমন্ত্রী বলেন, “মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে যুক্তদের ক্ষমা করা হয়নি। তবে যারা পাকিস্তানিদের পক্ষে সমর্থন দিয়েছিলেন, কিন্তু খুন, ধর্ষণসহ বিভিন্ন অপরাধে যুক্ত হননি, তাদের ক্ষমা করে দেওয়া হয়েছিলো।”
এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘দেশ স্বাধীনের পর বাংলাদেশ কলাবরেটর আইন’১৯৭২ এর অধীনে ৩৭ হাজার অপরাধীকে আটক করা হয়েছিলো। তাদের মধ্যে হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষণ, লুটতরাজ, ধর্মান্তরিত করাসহ ৬টি সুনির্দিষ্ট মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত ১১ হাজার অপরাধীকে বিচারের মুখোমুখি করা হয়। এ অপরাধীদের বিচারের জন্য ৬৩টি স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। বিভিন্ন ট্রাইব্যুনালে ২২ জনকে মৃত্যুদণ্ড, ৬৮ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং ৭৫২ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে দণ্ডিত করা হয়।’’
‘‘১৯৭৫ সালে জাতির জনককে স্বপরিবারে হত্যা করার পর সামরিক শাসকগোষ্ঠী কলাবরেটর অ্যাক্ট বাতিল করে দণ্ডিত আটক যুদ্ধাপরাধীদের ছেড়ে দেয়। ১৯৭৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর আসামিদের মুক্ত করে দেওয়া হয়। জেনারেল জিয়াউর রহমান ১৯৭৯ সালের ৬ এপ্রিল ৫ম সংশোধনীর মাধ্যমে সামরিক ফরমানের বৈধতা দেন। তিনি যুদ্ধাপরাধীদের রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবেও প্রতিষ্ঠিত করেন।’’
রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বিচার করা হচ্ছে কিনা এমন প্রশ্নে তথ্যমন্ত্রী বলেন, “আইনে অপরাধী ব্যক্তির পাশাপাশি গোষ্ঠী ও দলের বিচার করারও সুযোগ রয়েছে। আমরা তা করিনি। ব্যক্তির অপরাধের বিচার করছি।”
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের উদাহরণ টেনে হাসানুল হক ইনু বলেন, “জার্মানিতে নাজি পার্টিকে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বিগত ৫০ বছরেও তারা বৈধভাবে রাজনীতি করতে পারছে না।”
ট্রাইবুনালের নিরপেক্ষতার প্রশ্নে তথ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল সম্পূর্ণ স্বাধীন। কেউ আদালতের বিচার কার্যক্রমে হস্তক্ষেপ করছেন না।’’
তথ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘আইনের অপব্যাখ্যা, ভুল ব্যাখ্যা, ঢালাওভাবে বক্তব্যের মাধ্যমে যেসব গুজব ছড়ানো হচ্ছে, সেগুলো উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। বিচার ভণ্ডুল বা বন্ধ করতেই এগুলো করা হচ্ছে।’’
মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্তদের পুনর্বিচারে আসামিপক্ষের আবেদনের বিষয়ে তথ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘বিচারক পদত্যাগ করলে, বিচারক অপসারণ হলে, বিচারক মারা গেলে কিংবা অসুস্থ হলে বিচার বাধাগ্রস্ত হয় না। আইন অনুসারে বিচারিক প্রক্রিয়া যে অবস্থায় রয়েছে, সে অবস্থা থেকেই শুরু করতে হয়।’’
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম বন্ধে জামায়াত-বিএনপির পক্ষ থেকে যেসব বক্তব্য আসছে, সেসবও খণ্ডন করেন মন্ত্রী।
বিএনপি-জামায়াত বিচার বন্ধ করার চেষ্টা চালাচ্ছে অভিযোগ করে তথ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘বিএনপি বিচার বন্ধের সরাসরি প্রস্তাব দিয়েছে। জামায়াত-বিএনপি বিচার বন্ধে সরাসরি আক্রমণও চালাচ্ছে।’’
‘বিএনপি যুদ্ধাপরাধের বিচার চায়’ সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের প্রেক্ষিতে তথ্যমন্ত্রী বলেন, “বিচার বানচালের উদ্দেশ্যে ডাকা হরতালের বিএনপি সমর্থন দিয়েছে। এতেই তারা বিচার চায় কিনা, তা স্পষ্ট।”
তিনি বলেন, ‘‘বিএনপি-জামায়াত রাখ-ঢাক বা লাজ-লজ্জা না রেখেই বিচার বানচাল করতে আইনের অপব্যাখ্যা, ভুল ব্যাখ্যা করছে। বিচারাধীন বিষয় নিয়ে বিভ্রান্তিকর তথ্য দেওয়া হচ্ছে।’’
স্কাইপিতে সংলাপ হ্যাক করা হয়েছে বলে অভিযোগ করে মন্ত্রী ইনু বলেন, ‘‘এ নিয়ে নতুন করে আইন করার প্রয়োজন নেই। প্রচলিত আইনেই দেশের মাটিতে অথবা বাইরের যে কোনো দেশে আলাপচারিতা হ্যাক করা দণ্ডনীয় অপরাধ।’’
বিচার সুষ্ঠুভাবে হচ্ছে এবং আসামিদের অধিকার নিশ্চিত করা হচ্ছে উল্লেখ করে ইনু আরও বলেন, ‘‘আসামিরা আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ পাচ্ছেন। আসামিরা ইচ্ছেমতো আইনজীবী নিয়োগ করতে পারছেন। জামিন আবেদন করতে পারছেন এবং আপিলের সুযোগ রয়েছে। এছাড়া আসামিপক্ষ সাক্ষীকে জেরা করতে পারছেন।’’
বিচার আগে না করার বিষয়ে ব্যাখ্যা দিয়ে ইনু বলেন, “সামরিক সরকারের গর্ভে গঠিত সরকার বিচার বন্ধের পর এরশাদ সরকারের সময় আর বিচারের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। গণতান্ত্রিক সরকার হিসেবে নির্বাচিত হয়েও খালেদা জিয়াও বিচার বন্ধ রাখেন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ইনডেমিনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বিচার শুরু করে। জেলহত্যা মামলার বিচার শুরু করে। সে সময়ই যুদ্ধাপরাধের বিচারের উদ্যোগও নেওয়া হয়েছিলো। তবে এর আগেই সরকারের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়।’’
‘‘পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় এলে ১৯৭৩ সালের আইনে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে বিচার কাজ শুরু হয়।”
ট্রাইবুনাল নিয়ে বিতর্ক তোলার বিষয়ে মন্ত্রী সরকারের অবস্থান স্পষ্ট করতে বলেন, “সুপ্রিম কোর্টের মাধ্যমে ট্রাইব্যুনালের বৈধতা নিশ্চিত করা হয়েছে।”
ট্রাইব্যুনালের গ্রহণযোগ্যতার প্রশ্নে তিনি বলেন, “পৃথিবীর কোনো যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে যা নেই, তাও এই ট্রাইব্যুনালে রয়েছে।”
১৯৭৩ সালের আইন সংশোধন করে আসামিদের আত্মপক্ষ সমর্থন, জামিন ও আপিলের সুযোগ দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশের আইনে বিদেশি আইনজীবীদের এ ট্রাইব্যুনালে শুনানি করার সুযোগ নেই বলেও উল্লেখ করেন ইনু।
বিদেশি আইনজীবীদের শুনানি করতে দেওয়া হয় না প্রসঙ্গে তথ্যমন্ত্রী আরো বলেন, পৃথিবীর কোথাও এ সুযোগ নেই। বার কাউন্সিলের আইনে বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এখানে সরকারের কিছু করার নেই।
এ বিষয়ে তিনি উদাহরণ টেনে বলেন, “আগরতলা মামলায় থামস উইলিয়ামকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। বিগত সময়ে শেখ হাসিনার জন্য মি. গ্লোনকেও ঢুকতে দেওয়া হয়নি।”
সরকার ও জনগণ মানবতাবিরোধী অপরাধীদের ব্যাপারে সহনশীলতার পরিচায় দিয়েছে উল্লেখ করে তথ্যমন্ত্রী বলেন, “দেশের কোনো জনগণ আইন নিজের হাতে তুলে নেয়নি। তারা বিচারের অপেক্ষায় রয়েছে।”
সাংবাদিকদের মাধ্যমে সবাইকে মানবতাবিরোধী অপরাধ বিচরে সহায়তার আহ্বান জানিয়ে তথ্যমন্ত্রী বলেন, “একাত্তরে ক্ষতিগ্রস্তদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার কথা না বলে, যারা অপরাধ করেছেন তাদের ন্যায়বিচারের কথা বলা হচ্ছে।’’
এ অবস্থায় সবাইকে ক্ষতিগ্রস্তদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে সবাইকে সচেতন করার অাহবানও জানান মন্ত্রী।
দুই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল মিলিয়ে বর্তমানে যুদ্ধাপরাধের ১৪টি মামলার বিচার প্রক্রিয়া চলছে। এতে গ্রেফতারকৃত ও পলাতক জামায়াতের সাবেক-বর্তমান ১০ শীর্ষ নেতা এবং বিএনপির ২ নেতাসহ স্থানীয় পর্যায়ের আরও ২ আসামির বিচার করা হচ্ছে। এ মাসের মধ্যেই ট্রাইব্যুনালে তোলা হচ্ছে বুদ্ধিজীবী হত্যার দুই শীর্ষ খুনি আলবদরের মামলা। আরো কিছু মামলাও তদন্তাধীন।
মানবতাবিরোধী অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধ বিচারে ২০১০ সালের ২৫ মার্চ প্রথম ট্রাইব্যুনাল গঠন করে সরকার। এতে হাইকোর্টের বিচারপতি নিজামুল হক নাসিমকে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেওয়া হয়। চলতি বছরের ২২ মার্চ অপর বিচারপতি এটিএম ফজলে কবীরকে চেয়ারম্যান করে দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়।
স্কাইপেতে সংলাপের সংবাদ প্রকাশের পর বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম গত ১১ ডিসেম্বর পদত্যাগ করেন। তার পদত্যাগে ট্রাইব্যুনাল-১ এ শূন্যতা সৃষ্টি হয়। ১৩ ডিসেম্বর এ শূন্যতা পূরণ করে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখতে নতুন বিচারক নিয়োগ ও দুটি ট্রাইব্যুনালকে পুনর্গঠন করে সরকার।
এতে ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান হন ট্রাইব্যুনাল-২ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি এটিএম ফজলে কবীর এবং ট্রাইব্যুনাল-২ এর চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ পান একই ট্রাইব্যুনালের বিচারক প্যানেলের সদস্য বিচারপতি ওবায়দুল হাসান।
এদিকে এর সুযোগ নিয়ে কয়েকটি মামলার পুনর্বিচারের আবেদনসহ ট্রাইব্যুনালে বিভিন্ন আবেদন করছেন আসামিপক্ষ ও জামায়াতের আইনজীবীরা। বিচারকে বিলম্বিত করা ও দীর্ঘসূত্রতায় ফেলতে এসব আবেদন করা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
পাশাপাশি ট্রাইব্যুনাল ও বিচারাধীন মামলাসহ যুদ্ধাপরাধ বিচারের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ছড়ানো হচ্ছে বিভ্রান্তি, চলছে অপপ্রচার। বিচার বানচালের প্রচেষ্টায় এসব ছাড়াও নানা ষড়যন্ত্র ও আন্দোলনের নামে সহিংসতাও চলছে।
এ প্রেক্ষাপটেই জনমনের বিভ্রান্তি দূর করে ধারণা স্বচ্ছ এবং যুদ্ধাপরাধের বিচার সম্পন্ন করার অঙ্গীকার পূরণে আশ্বস্ত করতেই সরকার তার অবস্থান স্পষ্ট করার উদ্যোগ নেয়।