ঋণের গুণগত মান খারাপ হয়ে আসায় দেশের ব্যাংকগুলোয় ঝুঁকিনির্ভর সম্পদের পরিমাণ ক্রমশ বাড়ছে। এর ফলে প্রয়োজন দেখা দিচ্ছে নতুন মূলধন সংস্থানের।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হিসাবে, প্রয়োজনীয় মূলধন সংরক্ষণে ব্যর্থ হয়েছে সাতটি ব্যাংক। এর মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় রয়েছে সোনালী ব্যাংক।
মূলধন ঘাটতির তালিকায় তিন মাস আগে ছিল চারটি ব্যাংক। এখন পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকগুলোর গড় মূলধন সংরক্ষণের হার কমে হয়েছে ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের ১০ দশমিক ৮৫ শতাংশে। গত জুন শেষে যা ছিল ১১ দশমিক ৩১ শতাংশ। আর গত বছরের ডিসেম্বর শেষে এই হার ছিল ১১ দশমিক ৩৫ শতাংশ।
বিশ্লেষকেরা মনে করেন, মূলধন ঘাটতি যেহেতু রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকেই বেশি, তাই সরকারকে তা জোগানে এগিয়ে আসতে হবে। আর ব্যাংকগুলোকে ভালো বিনিয়োগের মাধ্যমে ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদ কমিয়ে আনতে হবে।
সূত্র জানায়, হল-মার্ক কেলেঙ্কারির কারণে সোনালী ব্যাংকে বেশি পরিমাণে মূলধন ঘাটতি দেখা দিয়েছে। রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলো সরকারি দলের প্রভাবশালীদের চাপের মুখে থাকে। এই ব্যাংকগুলোর ঋণ বা বিনিয়োগ সঠিকভাবে যাচাইয়ের দক্ষতাও কম। উপরন্তু, একধরনের দায়িত্বহীনতাও থাকে। ফলে অনেক ক্ষেত্রেই পরবর্তীকালে বিপুল পরিমাণ ঋণ খেলাপি হয়ে পড়ে। নিরাপত্তা সঞ্চিতি (প্রভিশন) সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। এর প্রভাবে মূলধন ঘাটতি হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে ব্যাংকের মূলধনের হিসাব রাখে। সূত্র জানায়, গত জুনের হিসাবে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী এবং আইসিবি ইসলামী ব্যাংকে মূলধন ঘাটতি ছিল। তবে সেপ্টেম্বর শেষে এদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রাষ্ট্রমালিকানাধীন সোনালী ও রূপালী ব্যাংক এবং বেসরকারি খাতের ইউসিবিএল।
ব্যাংকিংয়ে আন্তর্জাতিক মান (ব্যাসেল-২) অনুযায়ী বাংলাদেশে বর্তমানে ন্যূনতম ৪০০ কোটি টাকা অথবা ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের ১০ শতাংশ, এর মধ্যে যা বেশি, সেই পরিমাণ অর্থ মূলধন হিসেবে সংরক্ষণ করতে হয় ব্যাংকগুলোকে। ঝুঁকিনির্ভর সম্পদ হিসাবে একটি সময় শুধু ঋণ ঝুঁকিকে বিবেচনা করা হতো। এখন ঋণ, বাজার ও পরিচালন ঝুঁকিকে বিবেচনা করা হয়। এই তিন ঝুঁকি বিবেচনায় নিয়ে সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে মোট ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদ দাঁড়িয়েছে পাঁচ লাখ ১০ হাজার ৪০ কোটি টাকা। এর বিপরীতে ১০ শতাংশ হারে ৫৩ হাজার ২৬২ কোটি টাকা মূলধন সংরক্ষণের প্রয়োজন রয়েছে।
রাষ্ট্রমালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে মূলধন সংরক্ষণের প্রয়োজন রয়েছে ১০ হাজার ৪২৪ কোটি টাকা। কিন্তু, সংরক্ষণ করা হয়েছে ১০ হাজার ১৫৪ কোটি টাকা। ফলে ঘাটতি রয়েছে ২৭০ কোটি টাকা।
বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোতে দুই হাজার ৭২৪ কোটি টাকা সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তার বিপরীতে ঘাটতি রয়েছে চার হাজার ৩৬০ কোটি টাকা।
আর বেসরকারি ও বিদেশি মালিকানার ব্যাংকগুলোতে প্রয়োজনের তুলনায় বেশি মূলধন সংরক্ষিত রয়েছে।
সবচেয়ে খারাপ অবস্থা সোনালী ব্যাংকের। গত জুন শেষে যেখানে ব্যাংকের প্রয়োজনীয় মূলধনের তুলনায় ৭১৭ কোটি টাকা বেশি সংরক্ষিত ছিল, তিন মাসের ব্যবধানে সেপ্টেম্বরে তা ঘাটতি হয়েছে ৩৭৮ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। একই সঙ্গে ব্যাংকটির প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে এক হাজার ১৮ কোটি টাকায়। হল-মার্কসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের ঋণ জালিয়াতির কারণে তাদের ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদ বৃদ্ধি হওয়ায় এই অবস্থা হয়েছে।
সেপ্টেম্বর শেষে রূপালী ব্যাংকের ঘাটতি হয়েছে ৭৩ কোটি ৭৪ লাখ টাকা। তিন মাস আগে উদ্বৃত্ত ছিল ৫৭ কোটি ৭৪ লাখ টাকা। ইউসিবিএলের ঘাটতি হয়েছে ৩২ কোটি ১০ লাখ টাকা। জুন শেষে অতিরিক্ত ছিল ছয় কোটি ২৩ লাখ টাকা। এ দুটি ব্যাংকেই বেশ কয়েকটি ঋণ অনিয়ম সম্প্রতি ধরা পড়েছে।
এ ছাড়া অনেক দিন ধরেই চারটি ব্যাংকে মূলধন ঘাটতি রয়েছে। সেপ্টেম্বর শেষে বিশেষায়িত কৃষি ব্যাংকে ঘাটতি দাঁড়িয়েছে চার হাজার ৫১৮ কোটি টাকা, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকে ৫১৮ কোটি টাকা, বেসরকারি ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকে ১৩৯ কোটি টাকা এবং আইসিবি ইসলামী ব্যাংকে এক হাজার ২৮০ কোটি টাকা।