দেশের মানচিত্র ‘পাল্টানোর ষড়যন্ত্র’ চলছে অভিযোগ করে সরকার ‘হটানোর’ আন্দোলনে মুক্তিযোদ্ধাদের শরিক হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া।
বুধবার বিকালে মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, “কারো পদানত হতে নয়, মাথা উঁচু করে স্বাধীনভাবে বাঁচার জন্য মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ করে এই দেশ স্বাধীন করেছেন।
“আজ দেশের মানচিত্র পাল্টানোর ষড়যন্ত্র চলছে। সীমান্তে বাংলাদেশিরা প্রতিনিয়ত নিহত হচ্ছে। ফেলানীর লাশ কাঁটাতারে ঝুলে থাকে।”
বিজয় উপলক্ষে গুলিস্তানের মহানগর নাট্যমঞ্চ প্রাঙ্গণে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য এই সংবর্ধনার আয়োজন করে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি।
দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া মুক্তিযোদ্ধাদের এই সংবর্ধনা দেন। অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত মুক্তিযোদ্ধাদের লাল-সবুজ ক্যাপ ও সাদা গেঞ্জি উপহার দেয়া হয়।
মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে আসতে ক্ষমতাসীনদের ‘বাধা প্রদানের’ নিন্দা জানিয়ে খালেদা বলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের আওয়ামী লীগ সরকার ভয় পায় বলেই তারা বাধা দিয়েছে। তারা জানে রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধাদের ডাক দিলে তারা দেশরক্ষার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়বেন।
“আমি মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি আহবান জানাব, আসুন দেশকে রক্ষার জন্য এই ফ্যাসিস্ট সরকারকে বিদায় করতে গণতন্ত্রের সংগ্রামে শরিক হই। সরকার বিদায় না হওয়া পর্যন্ত আমাদের এই সংগ্রাম শেষ হবে না।’’
আগামীতে ক্ষমতায় গেলে মুক্তিযোদ্ধা ভাতা বৃদ্ধিরও প্রতিশ্রুতি দেন খালেদা জিয়া।
সীমান্তে বাংলাদেশি নাগরিক হত্যার প্রসঙ্গ টেনে এব্যাপারে সরকারের পদক্ষেপেরও সমালোচনা করেন বিএনপি চেয়ারপারসন।
“সীমান্তের কাঁটাতারে ফেলানীর লাশ ঝুলে থাকে, সরকার তার প্রতিবাদ জানাতে পারে না। আমরা যুদ্ধ করে এই দেশ স্বাধীন করেছি, কারো করুণায় এই স্বাধীনতা আসেনি।
“আমরা সমমর্যাদার ভিত্তিতে বন্ধুত্ব চাই। আমাদের কোনো প্রভু নেই। কিন্তু আওয়ামী লীগ তা মনে করে না। তারা বাংলাদেশকে অন্য দেশের পদানত করে রাখতে চায়।”
ভারতের দিকে ইঙ্গিত করে বিএনপি চেয়ারপারসনের যে এই বক্তব্য তা স্পষ্ট, এর আগেও তার মুখে একই কথা শোনা গেছে।
তবে সম্প্রতি ভারত সফরে গিয়ে খালেদা জিয়া দেশটির নেতাদের বলেছেন, নয়া দিল্লির সঙ্গে নতুন আঙ্গিকে সম্পর্ক গড়ে তুলতে আগ্রহী বিএনপি।
সফরে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংকে তিনি এই নিশ্চয়তা দিয়েছেন, বিএনপি ক্ষমতায় গেলে ভারতের স্বার্থের বিরুদ্ধে কোনো বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীকে বাংলাদেশের ভূখ- ব্যবহার করতে দেবে না।
বিকাল সোয়া ৩টার দিকে অনুষ্ঠানস্থলে আসার পর মঞ্চে উঠে বিরোধীদলীয় নেত্রী মুক্তিযোদ্ধাদের সালাম জানান। এ সময়ে সারাদেশ থেকে আসা মুক্তিযোদ্ধারা দাঁড়িয়ে হাত তুলে খালেদা জিয়ার সালামের জবাব দেন।
একাত্তরের শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে খালেদা বলেন, “আপনাদের আত্মত্যাগে এই স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টি হয়েছে।”
দেশের বর্তমান অবস্থা তুলে ধরতে গিয়ে তিনি বলেন, “দ্রব্যমূল্যের দাম কমেনি। সারাদেশে উন্নয়ন কর্মকান্ড কমে গেছে। কিন্তু তা থেকে উত্তরণে সরকারের কোনো উদ্যোগ নেই।
“তারা (সরকার) ব্যস্ত আছে- কোথায় কমিশন পাওয়া যাবে, কীভাবে লুট-পাট করা যাবে।”
তিনি দাবি করেন, হলমার্ক, ডেসটিনি, ভিওআইপি, রেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্ট ও পুঁজিবাজার থেকে ক্ষমতাসীনরা কোটি কোটি টাকা ‘লুটপাট’ করে বিদেশে পাচার করেছে।
বিরোধীদলীয় নেতা প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্যদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে অভিযোগ করেন, সরকারের মন্ত্রী, উপদেষ্টা, প্রধানমন্ত্রীসহ তার আত্বীয় স্বজনরা ‘চোর’। এই ‘চোরদের’ দিয়ে দেশের কোনো উন্নয়ন হবে না। তাই পরিবর্তন আনতে হবে।
নির্দলীয় সরকারের অধীনেই আগামী নির্বাচন হবে- এ প্রত্যয় পুনর্ব্যক্ত করে তিনি বলেন, “এদেশে আওয়ামী লীগের অধীনে কোনো নির্বাচন হবে না। আমরা নির্দলীয় সরকারের দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাব।”
খালেদা অভিযোগ করেন, সরকার মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ বিরোধী দলের ২৫ হাজার নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে।
সরকারকে হুঁশিয়ার করে দিয়ে তিনি বলেন, এভাবে গ্রেপ্তার করে ‘মিথ্যা’ মামলা দিয়ে আন্দোলন বন্ধ করা যাবে না।
“শুনে রাখুন- এখন থেকে মাইনাস হবে আওয়ামী লীগের, আর প্লাস হবে ১৮ দলীয় জোটের।’’
পুরান ঢাকায় গত ৯ ডিসেম্বর রাজপথ অবরোধের সময়ে বিশ্বজিত দাস হত্যাকা- সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের কঠোর সমালোচনা করে বিরোধীদলীয় নেতা দাবি করেন, ছাত্রলীগ এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে, তারপরও প্রধানমন্ত্রী ‘মিথ্যা’ বলে যাচ্ছেন।
“এতে কোনো লাভ হবে না। জনগণ আপনাদের চিনে গেছে।”
বিগত চার দলীয় জোট সরকারের আমলে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় গঠনের কথা উল্লেখ করে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য নেয়া বিভিন্ন পদক্ষেপও তুলে ধরেন খালেদা।
তিনি বলেন, “আমরা এই মন্ত্রণালয় গঠন করেছি। সময় বেশি পাইনি বলে অনেক কাজ করতে পারিনি। তাই আমি বলতে চাই- দেশের অর্থনীতি ও বাজারের যে অবস্থা, মুক্তিযোদ্ধারা কষ্টে আছেন। আমরা আগামীতে ক্ষমতায় গেলে মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা বৃদ্ধি করবো।”
মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণে এই মন্ত্রণালয়কে আরও কার্যকর ও শক্তিশালী করা এবং একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাকে এই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়ার প্রতিশ্রুতিও দেন তিনি।
মুক্তিযোদ্ধা সংবর্ধনা জাতীয় কমিটির আহবায়ক শাহজাহান ওমরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির সভাপতি অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল অলি আহমেদ, কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল মুহাম্মদ আইনুদ্দিন, সাবেক প্রতিরক্ষা প্রতিমন্ত্রী নুরুল ইসলাম মঞ্জুর, বিভিন্ন জেলা থেকে আসা মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে আবদুল জাব্বার, আবদুল মজিদ, সৈয়দ ফজলুল হক ইফতারী, শাহজাহান মিয়া, শাহ মুহাম্মদ আবু জাফর, সিরাজুল হক, মুহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন, শাহজাদা মিয়া, মুজাফফর আহমেদ, আবিদুর রহমান, আবুল হোসেন, শেখ আতাউর রহমান, সৈয়দ হারুনুর রশীদ, জহির উদ্দিন বাবুল, চৌধুরী আবু তালেব, এম এ খালেক, সদ্য যোগদানকারী মুক্তিযোদ্ধা গণপরিষদের চেয়ারম্যান ইশতিয়াজ আজিজ উলফাত, মহাসচিব সাদেক আহমেদ খান প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।
এছাড়া বিএনপি নেতা খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মওদুদ আহমদ, তরিকুল ইসলাম, মির্জা আব্বাস, সহসভাপতি শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, সাদেক হোসেন খোকা, আবদুল্লাহ আল নোমান, হাফিজ উদ্দিন আহমেদ, শমসের মবিন চৌধুরী, সাংসদ জয়নুল আবেদীন (ভিপি জয়নাল), বিরোধী দলীয় প্রধান হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুক, জাতীয়তাবাদী মুক্তিযোদ্ধা দলের সভাপতি অধ্যক্ষ সোহরাব উদ্দিন, সাধারণ সম্পাদক এস এম শফিউজ্জামান খোকন, অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা জয়নাল আবেদীন, রেজাউল হক, মো. মনিরুজ্জামান, ইসমাইল হোসেন বেঙ্গল, জাতীয়তাবাদী মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্মের সভানেত্রী শ্যামা ওবায়েদ প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।
অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন মহানগর বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক মসিউর রহমান ও মহানগর সদস্য সচিব আবদুস সালাম।