কেরাণীগঞ্জের চাঞ্চল্যকর শিশু পরাগ মণ্ডল অপহরণের প্রধান আসামি আমির হোসেন মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সঙ্গে ক্রসফায়ারে আহত হয়েছেন। মাথায় গুলিবিদ্ধ আমির বর্তমানে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে রয়েছেন।
তবে ডিবি পুলিশ প্রথমে আমিরের নিহত হওয়ার দাবি করলেও পরে জানায়, তাকে গুরুতর আহত অবস্থায় ঢামেক হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। আমিরের সঙ্গে থাকা তার দ্বিতীয় স্ত্রী বিউটিকেও আটক করেছে ডিবি পুলিশ। তাদের কাছ থেকে দু’টি অত্যাধুনিক বিদেশি পিস্তল ও ৮৫ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করা হয়েছে বলেও জানায় ডিবি।
শনিবার ভোররাত সাড়ে ৩টা থেকে ৪টার মধ্যে টঙ্গিতে ক্রসফায়ারের ওই ঘটনা ঘটে। ঘটনাস্থল থেকে মাথায় গুলিবিদ্ধ আমিরকে প্রথমে টঙ্গি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখান থেকে পরে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আনা হয়।
ডিবি পুলিশের অভিযান পরিচালনাকারী দলের সদস্য ইন্সপেক্টর মেজবাহউদ্দিন জানান, আমিরের সহযোগী গ্রেফতারকৃত আলামিনের দেওয়া তথ্যে ডিবি পুলিশ জানতে পারে, আমির হোসেন টঙ্গি এলাকায় রয়েছেন। এ খবরে শুক্রবার রাতভর টঙ্গির বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালানো হয়। এক পর্যায়ে স্থানীয় জমি কেনা-বেচার দালাল মোরশেদ এবং শাহেদকে আটক করে ডিবি। তাদের কাছ থেকেই নিশ্চিত হওয়া যায়, টঙ্গির টিলাবাসী নামক এলাকার একটি একতলা বাড়িতে ভাড়া নিয়ে দ্বিতীয় স্ত্রী বিউটিকে নিয়ে বসবাস করছেন।
তিনি আরো জানান, এ সংবাদে পরে টিলাবাসী এলাকার ওই একতলা বাড়িটি ঘিরে ফেলেন ডিবি সদস্যরা। প্রায় ঘণ্টাখানেক দরজায় ধাক্কাধাক্কির পর রাত সাড়ে ৩টার পরে নিজেই দরজা খুলে দেন আমির।
দরজা খুলেই আমির ডিবি পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি করতে শুরু করেন। ডিবি পুলিশও পাল্টা গুলি ছুড়লে মাথায় গুলিবিদ্ধ হন আমির। এরপর তাকে আটক করে প্রথমে টঙ্গি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখান থেকে ভোর ৫টার দিকে গুরুতর অবস্থায় আমিরকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আনা হয়।
ইন্সপেক্টর মেজবাহউদ্দিন জানান, পরাগ অপহরণের ঘটনায় পুলিশের ব্যাপক অভিযানের মুখে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছিলেন আমির। এর আগে স্থানীয় জমি কেনা-বেচার দালাল মোরশেদ এবং শাহেদের মাধ্যমে টঙ্গিতে জমি কিনেছিলেন তিনি। সেই পরিচয়ের সূত্র ধরে তাদের মাধ্যমেই সপ্তাহখানেক আগে টিলাবাসী এলাকার ওই একতলা বাড়িটি ভাড়া নেন আমির। ভাড়া নেওয়ার সময় তিনি বিদেশ থেকে এসেছেন বলে পরিচয় দেন। এরপর থেকে দ্বিতীয় স্ত্রী বিউটিকে নিয়ে সেখানে আত্মগোপন করে ছিলেন।
তিনি জানান, বিউটিকেও আটক করা হয়েছে। আটকের সময় আমিরের কাছ থেকে ৮৫ রাউন্ড গুলিসহ দু’টি অত্যাধুনিক স্পেনের তৈরি দু’টি পয়েন্ট টুটু বোরের পিস্তল উদ্ধার করা হয়েছে। এ পিস্তল দু’টি দিয়েই আমির ডিবির সঙ্গে গুলি বিনিময় করছিলেন বলেও জানান ডিবির কর্মকর্তা মেজবাহ।
উল্লেখ্য, মঙ্গলবার গভীর রাতে তার এক সহযোগীসহ আমির হোসেনকে গ্রেফতারের খবর শোনা গেলেও পরে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের পক্ষ থেকে তার ওই সহযোগী আলামিনকে গ্রেফতারের খবর নিশ্চিত করা হয়। আলামিন বর্তমানে পরাগ অপহরণ মামলায় রিমান্ডে রয়েছেন।
রাজবাড়ী জেলার গোয়ালন্দ ঘাট থেকে তাদের গ্রেফতার করা হয়েছিল বলে সে সময় খবর ছড়ায়। তাদের কাছ থেকে অপহরণের কাজে ব্যবহৃত একটি মোটরসাইকেল জব্দ করা হয়েছে বলেও শোনা যায়।
বৃহস্পতিবার পরাগ অপহরণের মূল পরিকল্পনাকারী ও নির্দেশদাতা বলে অভিযুক্ত যুবলীগ নেতা আমিনুল হক ওরফে মোল্লা জুয়েলকেও কেরাণীগঞ্জের সুভাঢ্যার পূর্বপাড়ার একটি বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে ডিবি পুলিশ। জুয়েলকেও আলামিনের সঙ্গে রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ।
উল্লেখ্য, র্যাব ও পুলিশের অভিযানে পরাগ অপহরণের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে এ পর্যন্ত জুয়েল ও আলামিনসহ মোট ৯ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
এর আগে ১৪ নভেম্বর বুধবার দিবাগত রাতে র্যাব-১০- এর একটি টিম অভিযান চালিয়ে পূর্ব জুরাইনের ৭৮৪/১ রোকেয়া চৌধুরীর বাসার ছাদ থেকে ৬ জনকে গ্রেফতার করে। তারা হলেন মো: জাহিদুল ইসলাম (১৯), মোহাম্মদ আলী রিফাত (১৯), মো: কালাচান (৩৫), আবুল কাশেম (৩৬), রিজভী আহম্মেদ অনিক (১৯) ও আফজাল হোসেন (১৭)।
ওই দিন র্যাব কর্মকর্তারা সাংবাদিক সম্মেলনে জানান, পরাগ মণ্ডল অপহরণের মূল নায়ক আমির ও তার দুই সহযোগী। এদেরই একজন আলামিন।
একই দিন পুলিশ মামুন নামের একজনকে অপহরণের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেফতার করে।
উল্লেখ্য, গত ১১ নভেম্বর রোববার সকাল সোয়া ৭টায় স্কুলে যাওয়ার জন্য কেরাণীগঞ্জের সুভাঢ্যা পশ্চিমপাড়ার বাসার সামনে থেকে নিজেদের প্রাইভেটকারে ওঠার সময় মা লিপি মণ্ডল, বোন পিনাকী মণ্ডল ও তাদের গাড়িচালক নজরুলকে গুলি করে ৬ বছরের শিশু পরাগ মণ্ডলকে তার মায়ের কোল থেকে তুলে নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা।
পরাগ সদরঘাটের হিড ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে কেজি ওয়ানের ছাত্র। অপহরণের ৪৮ ঘণ্টা পর কেরাণীগঞ্জের আঁটিবাজার এলাকা থেকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করা হয় পরাগকে। উদ্ধারের পর তাকে স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসা দিয়ে বাড়ি নেওয়া হয়।
পরাগকে ৫০ লাখ টাকা মুক্তিপণের বিনিময়ে অপহরণকারীরা ছেড়ে দিয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
তবে মুক্তিপণ দেওয়া, না দেওয়ার ব্যাপারে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর ও র্যাবের পক্ষ থেকে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দেওয়া হয়েছে। র্যাব মুক্তিপণ দিয়ে পরাগকে উদ্ধার করা হয়েছে বলে স্বীকার করলেও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, এ দাবির পক্ষে কোনো প্রমাণ কারো হাতে নেই।