চীনের কমিউনিস্ট পার্টির জাতীয় সম্মেলনে ক্ষমতাসীন দলের প্রধান হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে মনোনীত করা হয়েছে শি জিনপিংকে। পাশাপাশি সাত সদস্য বিশিষ্ট চীনের সবোর্চ্চ ক্ষমতাশালী স্টান্ডিং কমিটি পলিটব্যুরোরও নেতৃত্ব দেবেন তিনি।
বেইজিংয়ে অনুষ্ঠিত দলীয় কংগ্রেসে বৃহস্পতিবার আনুষ্ঠানিকভাবে ৫৯ বছর বয়সী এই নেতাকে পরবর্তী দশকের জন্য চীনের সর্বোচ্চ ক্ষমতাশালী ব্যক্তি হিসেবে বেছে নেওয়া হয়।
তবে চীনের প্রেসিডেন্টের পদ তিনি লাভ করবেন আগামী বসন্তে। চীনা পার্লামেন্টের এক বিশেষ অধিবেশনে আনুষ্ঠানিকভাবে চীনের প্রেসিডেন্ট হিসেবে অভিষিক্ত করা হবে তাকে।
বর্তমানে ভাইস প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি চীনের কেন্দ্রীয় সামরিক কমিশনেরও ভাইস চেয়ারম্যানের দায়িত্বও পালন করছেন শি জিনপিং। এই কমিটিই চীনের শক্তিশালী সামরিক বাহিনীকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।
শির পূর্বসূরী হু জিনতাও নিজেও সর্বোচ্চ পদে আসীন হওয়ার আগে একই পদে থেকে দায়িত্ব পালন করেন। তাই পরবর্তী সর্বোচ্চ নেতা যে শি জিনপিংই হতে যাচ্ছেন বিশ্লেষকরা তা ধারণা করেছিলেন আগেই।
তবে রাজনীতিক হিসেবে শি জিনপিংয়ের উঠে আসা কুসুমাস্তীর্ন ছিলো না। অভিজাত রাজনৈতিক পরিবারে জন্ম নিলেও কৈশোর ও তারুণ্যে অশেষ দুর্ভোগ পোহাতে হয় তাকে। মূলত পিতার রাজনৈতিক পরিচয়ই চলার পথের শুরুতে তার জন্য দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
১৯৫৩ সালে রাজধানী বেইজিংয়ে জন্ম নেন তিনি। তার পিতা শি ঝংশুন ছিলেন চীনের কমিউনিস্ট বিপ্লবের কারিগর এবং মাও জে দংয়ের অন্যতম সহযোগী। পাশাপাশি তিনি ছিলেন চীনের ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা পিতা।
তবে সংস্কার প্রশ্নে মাও জে দংয়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ায় পরবর্তীতে কপাল পোড়ে শি ঝংশুনের। ১৯৬২ সালের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের আগ দিয়ে ভাইস প্রেসিডেন্টের পদ থেকে অপসারণ করে কারারুদ্ধ করা হয় তাকে।
একই সঙ্গে দুর্দশা নেমে আসে তার পরিবারের ওপরও। ১৫ বছর বয়সী কিশোর শিকে কৃষকদের সঙ্গে কাজ করতে পাঠানো চীনের প্রত্যন্ত লিয়াংজিয়া অঞ্চলে। সাংস্কৃতিক বিপ্লবের ওই সময় চীনের কমিউনিস্ট পার্টি শহুরে তরুণদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ও প্রশিক্ষণের জন্য প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে বাধ্যতামূলকভাবে প্রেরণ করতো।
তবে ওই সময়ই শির প্রতিভার স্বতঃস্ফূর্ত স্ফূরণ ঘটে। দিনের বেলা কৃষকদের সঙ্গে কঠিন পরিশ্রম, রাতে তাদের পাশেই মাথার নিচে ইট দিয়ে ঘুমানো । এমন পরিস্থিতিতে সাত বছর কাটিয়ে বেইজিংয়ের তিজুয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার জন্য ফেরেন তিনি।
সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্টের সন্তান হলেও তার সাধারণ জীবনাচারণ এবং সহজেই সবার সঙ্গে মিশে যাওয়ার ক্ষমতা সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে খুব সহজেই। সে সময়ের এক গ্রাম্য প্রধান যিনি ওই সময়ের শিকে চিনতেন শি জিনপিংকে ‘সৎ এবং দায়িত্বশীল’ বলে অভিহিত করেন তিনি।
পরবর্তীতে শি নিজেও বলেছেন কৈশোর ও তারুণ্যে তার এ কঠোর পরিশ্রমের অভিজ্ঞতাই তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক শিক্ষা।
পরবর্তীতে বেইজিংয়ের বিখ্যাত তিনজুয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কেমি কৌশলে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন শি । চীনের সম্মানজনক এই বিশ্ববিদ্যালয়কে অভিহিত করা হয় নেতৃত্ব নির্মাণের পাঠশালা হিসেবে। হু জিনতাও সহ চীনের অনেক শীর্ষনেতাই পড়াশোনা করেছেন এখানে।
১৯৭৪ সালে পার্টির সদস্যপদ লাভ করেন শি জিনপিং। তবে এর আগে পরপর সাতবার খারিজ হয় তার আবেদন। মূলত পিতার অতীত রাজনৈতিক ইতিহাসই তার ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
তবে ১৯৭৬ সালে মাওয়ের মৃত্যুর পরপরই দৃশ্যপট পরিবর্তিত হতে থাকে দ্রুত। রক্ষণশীলদের হটিয়ে চীনের নেতৃত্বের অগ্রভাগে আসেন সংস্কারপন্থিরা। যাদের অনেকেরই আদর্শ পুরুষ ছিলেন শি‘র পিতা।
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তার রাজনৈতিক জীবন তরতর করে সাফল্যের পথে এগিয়ে যাওয়ার ইতিহাস।
রাজনৈতিক জীবনের শুরুতে হেবেই প্রদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। সফলতার স্বীকৃতি হিসেবে পরবর্তীতে ফুজিয়ান এবং ঝেজিয়াং প্রদেশে দলের আরও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নিয়োগ দেওয়া হয় তাকে।
অবশেষে ২০০৭ সালে দুর্নীতির দায়ে চীনের গুরুত্বপূর্ণ সাংহাই নগরীর পার্টি প্রধান চেন লিয়াংগুই পদচ্যুত হলে তার স্থলে নিয়োগ পান তিনি।
এরপরই মূলত ভাগ্য খুলে যায় শির। প্রেসিডেন্ট হু জিনতাওয়ের নেক নজরে থাকার কারণে খুব অল্পসময়ের মধ্যেই দলের স্থায়ী কমিটিতে জায়গা করে নেন তিনি। এবং অবশেষে ২০০৮ সালে চীনের ভাইস প্রেসিডেন্ট পদটি লাভ করেন তিনি।
প্রশাসক হিসেবে সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতির ব্যাপারে তাকে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতিতে বিশ্বাসী বলে মনে করা হয়। পাশাপাশি সমস্যা সমাধানে দক্ষতার জন্য তাকে অভিহিত করা হয় ‘ট্রাবল শ্যুটার’ হিসেবে। ৯০ দশকের শুরুর দিকে ফুজিয়ান প্রদেশের দুর্নীতি ও অপরাধ চক্রের মূলৎপাটন করে খ্যাতি লাভ করেন তিনি।
শি কে স্পষ্টভাষী হিসেবেও মনে করেন অনেক বিশ্লেষক। ২০০৯ সালে মেক্সিকোতে এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে চীনের অর্থনৈতিক উত্থানে ঈর্ষাকাতর পশ্চিমা নিন্দুকদের কঠোর ভাষায় সমালোচনা করেন তিনি।
তিনি বলেন,“প্রথমত চীন তার বিপ্লব রপ্তানি করে না, দারিদ্র্য ও খরাও রপ্তানি করে না, এমনকি চীন পশ্চিমাদের সঙ্গে কোনো বিবাদেও জড়ায় না, তাহলে তাদের সমস্যা কোথায়?”, সমালোচকদের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন রাখেন তিনি।
তিব্বত প্রশ্নেও তাকে একজন কঠোর রক্ষণশীল বলে ধারণা করা হয়। সব কিছু মিলিয়ে সর্বোচ্চ নেতৃত্ব পাওয়ার পর শিকে আরও কঠোর এবং দৃঢ় ভঙ্গিমায় দেখা যেতে পারে বলে ধারণা করছেন অনেকেই।
পাশাপাশি কমিউনিস্ট ভাবাদর্শ থেকে ক্রমেই পিছু হটা চীনে জাতীয়তাবাদী মনোভাব বৃদ্ধি পাওয়ার প্রেক্ষিতে শিকে মনে করা হচ্ছে নব্য জাতীয়তাবাদীদের অন্যতম ভরসাস্থল হিসেবে।
ব্যক্তিগত জীবনে বিবাহিত ও এক কন্যা সন্তানের জনক শি জিনপিং। তার স্ত্রী বিখ্যাত চীনা লোকগীতি শিল্পী ও অভিনেত্রী পেং লিউয়ান । এ দম্পতির কন্যা শি মিংজে বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছেন বলে জানা গেছে।
প্রতি বছরই নতুন বছরের উৎসবে চীনের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনের অনুষ্ঠানে অংশ নিতে দেখা যায় শির স্ত্রীকে। একই সঙ্গে তিনি চীনা সামরিক বাহিনীতে মেজর জেনারেল হিসেবেও কর্মরত।
কাজের বাইরে শি জিনপিংয়ের শখ সম্পর্কে অল্পই জানা সম্ভব হয়েছে। যতদূর জানা গেছে বাস্কেটবল খেলতে পছন্দ করেন তিনি। পাশাপাশি ফাঁস হওয়া যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক তারবার্তা অনুযায়ী হলিউডের যুদ্ধ নির্ভর ছবিগুলো দেখতে পছন্দ করেন তিনি।
অবশ্য ১৯৮৫ সালে উচ্চতর ডিগ্রি গ্রহণের জন্য একবার যুক্তরাষ্ট্রে গমন করেছিলেন শি। তখন স্বল্প সময়ের জন্য তিনি বসবাস করেন আইওয়ার ক্ষুদ্র শহর মাসকাটিনে। চীনের সর্বোচ্চ নেতা হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক নির্ধারণের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসের এ অভিজ্ঞতা তার জন্য মূল্যবান হিসেবে বিবেচিত হবে বলে ধারণা করছেন বিশ্লেষকরা।
ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র সফরের সময় তিনি অবশ্য আবারও আইওয়া ঘুরে আসেন। পুরনো বন্ধুবান্ধব ও সুহৃদদের সঙ্গে সময় কাটানোর পাশাপাশি অতীত স্মৃতিচারণাও করেন তিনি।
সে সময়ই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কৌশলগত আস্থার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে নতুন ইঙ্গিত দেন তিনি। তিনি চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ককে এ সময় ‘একে অপরের দিকে অবিরাম গতিতে ধেয়ে চলা’ নদীর সঙ্গে তুলনা করেন।
সবশেষে বলা যায় শি জিনপিংয়ের নেতৃত্বে ইতিহাসে চীনের অবস্থান কোথায় তা নির্ধারণ করবে সময়। তবে এটুকু বলা যায়, নেতৃত্বের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছাতে কঠোর পরিশ্রমের পাশাপাশি তার জীবনে সংমিশ্রিত হয়েছে আধুনিক শিক্ষা, যা পরবর্তী দশকে চীনের রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে তাকে দেবে ভিন্ন এক মাত্রা।