ব্যাংকিং খাতের অসাধু চক্রের কারণে বিপর্যয়ে দেশের অর্থনীতি। জালিয়াতির মাধ্যমে চক্রটি বেপরোয়াভাবে অর্থ আ�সাতে জড়িত। দীর্ঘদিন ধরেই ব্যাংক সংশ্লিষ্ট শীর্ষ কর্তাদের সহায়তায় এ চক্র নানা কায়দায় এদেশের টাকা পাচার করে দিচ্ছে বিদেশে। এমনকি এক্ষেত্রে এক ব্যাংক সহযোগিতা করছে আরেক ব্যাংককে। সম্প্রতি হুণ্ডিসহ বিভিন্ন জালিয়াতির মাধ্যমে বিদেশ টাকা পাচারের সাথে জড়িত শতাধিক প্রতিষ্ঠানের সন্ধান পেয়েছে গোয়েন্দা সংস্থা। ইতিমধ্যে মধ্যে গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকে অসাধু চক্রের সদস্যদের একটি তালিকা তৈরি করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে দিয়েছে। সরকারের নির্দেশ পাওয়া গেলেই আইন-শৃ�খলা বাহিনী নামবে গ্রেফতার অভিযানে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, দেশে রাজনৈতিক সুশাসনের অভাবে অবৈধভাবে উপার্জিত অর্থের কর ফাঁকি দিতে এবং জবাবদিহিতা এড়াতে দেশ থেকে প্রতিবছরই হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশ পাচার হচ্ছে। টাকা পাচারে অনুসরণ করা হচ্ছে নানা কায়দা। তাছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পর্যাপ্ত নজরদারির অভাব এবং নিয়মিত অডিট না হওয়ার সুযোগ নিচ্ছে দেশে কর্মরত বেসরকারি ব্যাংকগুলো। বিদ্যমান এ সুযোগে ব্যাংকগুলোতে চলছে নিজেদের ইচ্ছেমাফিক। ব্যাংক ঋণের নামে লোপাট হয়ে যাচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকা। ঋণ হিসেবে দেয়া এ টাকার বেশিরভাগই ফেরত পাওয়ার কোনো আশা নেই। অভিযোগ রয়েছে, ব্যাংকিং খাতের এ লুটপাটের মচ্ছবের অংশ পাচ্ছে রাজনৈতিক প্রভাবশালীরাও। আলোচিত হলমার্ক কেলেঙ্কারির সাথে দেশের সরকারি-বেসরকারি ও বিদেশী মিলিয়ে মোট ৩৬টি ব্যাংকের সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পেয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এক্ষেত্রে ব্যাংকের টাকা জালিয়াতিতে এক ব্যাংক অন্য ব্যাংককে সহযোগিতা করেছে।
সূত্র জানায়, নানাভাবে প্রতিদিনই দেশ থেকে বিদেশে টাকা পাচার হচ্ছে। এক্ষেত্রে দেশের একশ্রেণীর ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদ সেকেন্ড হোমের নামে টাকা পাচার অব্যাহত রেখেছে। তাছাড়া ইতিমধ্যে মাল্টিলেভেল মার্কেটিংয়ের নামে অনেক কোম্পানিই হাজার হাজার কোটি টাকা বিভিন্ন দেশে পাচার করে দিয়েছে। পাশাপাশি টাকা পাচারের ঘটনায় মামলা হলেও তদন্ত করতে গিয়ে বিপাকে পড়ছে তদন্তকারী। কারণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো তদন্তকারীদের কোনো সহযোগিতা করছে না। এমনকি যারা টাকার চালান আটক করেন তারাও সাক্ষ্য দিতে রাজি নন। এ কারণে বেশিরভাগ টাকা পাচার মামলার তদন্ত ঝুলে থাকে। শুধুমাত্র টাকা পাচারের জন্যই হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরকে কব্জা করে রেখেছে অসংখ্য চক্র। প্রতিদিনই এ বিমানবন্দর দিয়ে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, দবাই, সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশে এদেশে থেকে বৈদেশিক মুদ্রা পাচার হচ্ছে। মুদ্রা পাচারের এ চক্রের সাথে শুধু এদেশীয় হোমড়াচোমড়াই নয়, বিদেশী রাঘব-বোয়ালও জড়িত থাকার প্রমাণ পেয়েছে গোয়েন্দা সংস্থা।
সূত্র আরো জানায়, এদেশ থেকে বিদেশে বৈদেশিক মুদ্রা পাচারের সাথে জড়িত মূল হোতারা বরাবরই থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। শুধুমাত্র হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরেই গত এক বছরে পাচারের সময় দেশী-বিদেশী প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকার মুদ্রা আটক হয়েছে। এসব ঘটনায় বাহক হিসেবে সিভিল এভিয়েশন কর্মচারী, বিমান ক্রু ও মানি এক্সচেঞ্জের মালিক গ্রেফতার হয়েছে। কিন্তু এসব ঘটনায় হওয়া মামলাগুলো বছরের পর বছর ধামাচাপা পড়ে থাকছে। তাছাড়া গ্রেফতার হয়েছে পাকিস্তান, ভারত ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের নাগরিকও। দেশ থেকে অব্যাহত মুদ্রা পাচারের কারণে ঝুঁকিতে পড়েছে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিই। কারণ ব্যাপক পাচারের কারণে দেশে মুদ্রার চাহিদা ও জোগানের মধ্যে ভারসাম্য থাকছে না। মুদ্রা পাচার এতোই ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে যে, বর্তমানে ঢাকায় সব দেশেরই মুদ্রা পাওয়া যায়। এমনকি কেউ ইচ্ছে করলে ইসরায়েল-ফিলিস্তিনের মুদ্রাও সংগ্রহ করতে পারবে। মূলত বিভিন্ন মানি এক্সচেঞ্জ থেকে এসব বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহ করা হয়। আর মানি এক্সচেঞ্জগুলো বৈদেশিক মুদ্রা জোগাড় করে ধাপে ধাপে। বিদেশের কালোবাজারে বেশি দামে বিক্রির লক্ষ্যে মুদ্রাপাচারের একটি অন্যতম কারণ। আবার কালো টাকাও পাচার হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রায়। তাছাড়া আমদানির ক্ষেত্রে আন্ডার ইনভয়েসের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা বিদেশ পাচার হচ্ছে। অথচ সরকার এ বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থাই নিতে পারছে না।
এ প্রসঙ্গে ব্যাংক সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র মতে, দেশ থেকে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা পাচারের ঘটনায় সরকারি রাজস্বই শুধু বঞ্চিত নয়, অর্থনীতিও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এজন্য জোরদার করতে হবে ব্যাংকিং খাতের মনিটরিং ব্যবস্থা। পাশাপাশি প্রয়োজন কঠোর আইনের প্রয়োগ ও সুশাসন। তা নাহলে এদেশ থেকে মুদ্রা পাচার কোনোভাবেই রোধ করা যাবে না।