কর ফাঁকি দিয়ে উপকূলীয় অঞ্চলে চলছে ইলিশের ব্যবসা। নোয়াখালীর হাতিয়া, ভোলার মনপুরা, মির্জাকালু, তজমুদ্দিন, দৌলতখাঁয় জেলেদের জালে প্রতিদিন ধরা পড়ছে কয়েক হাজার মণ ইলিশ। কিন্তু সরকারি নিয়ম না মেনে ব্যবসা করায় ইলিশ থেকে সরকার হারাচ্ছে বড় অংকের রাজস্ব।
হাতিয়া ও ভোলা ঘুরে দেখা যায়, এসব অঞ্চলে মাছ ধরার ট্রলার রয়েছে ৫ হাজারেরও বেশি। পালা করে প্রতিদিন এসব ট্রলার মেঘনা নদী ছাড়িয়ে বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরতে যায়। ট্রলারের আকার ও জাল অনুযায়ী প্রতিদিন ধরা পড়ে গড়ে ৬ হাজার মণ ইলিশ। বাংলানিউজকে এ তথ্য জানান স্থানীয় কয়েকজন ইলিশ ব্যবসায়ী।
ধরা পড়া ইলিশ স্থানীয় আড়ৎদারের হাত ঘুরে ইলিশ বেপারীর মাধ্যমে রাজধানীতে এসে পৌঁছায়। কিন্তু স্থানীয় আড়ৎদার ও মাছ বেপারীদের ব্যবসায়ীক কোন লাইসেন্স না থাকায় অনায়াসে তারা সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছে। অপরদিকে জেলেরাও মানছে না ব্যবসার নিয়ম নীতি। ফলে সেখান থেকেও হারাতে হচ্ছে প্রচুর রাজস্ব।
হাতিয়া থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে ছেড়ে আসা লঞ্চ এমভি টিপু ও পানামা করে এসব মাছ নিয়ে আসা হয় রাজধানীর বাজারে। ঘাটে ঘাটে লঞ্চ থামিয়ে প্রতিদিন ঢাকায় গড়ে আনা হয় ৩ হাজার মন ইলিশ। বাকি ৩হাজার মন ইলিশ স্থানীয় লঞ্চ কর্ণফুলী ও ট্রলারে করে নিয়ে যাওয়া হয় স্থানীয় বাজার ও আশে পাশের জেলাগুলোতেও।
ইলিশের বেপারী মো. ইউসুফের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বড় বড় ঝুড়ি বেঁধে ছোট বড় বিভিন্ন আকারের ইলিশ মাছ ঢাকায় আনা হয়। এসব ঝুড়িতে ৮ থেকে ১৫ মণ পর্যন্ত মাছ ধরে। আকার অনুযায়ী মাছের দামেও রয়েছে ব্যাপক তারতম্য। জাটকা ইলিশের মণ ৯ হাজার টাকা, বেলকা ১৩ হাজার টাকা এবং বড় আকাশের ইলিশ এলসির দাম রয়েছে প্রতি মণ ৪০ হাজার টাকারও বেশি।
মাছ ধরার ট্রলার থেকে প্রথমে মাছ সংগ্রহ করে স্থানীয় আড়ৎদার। তারপর সেই মাছে পর্যাপ্ত বরফ দিয়ে ঝুড়ি বেঁধে বেপারীরা লঞ্চে করে ঢাকায় নিয়ে ঢাকার আড়ৎদারের কাছে বিক্রি করে। হাতবদলের এই প্রক্রিয়ায় ট্রলারের জেলে, স্থানীয় আড়ৎদার ও বেপারীদের কারোরই নেই কোন ট্রেড লাইসেন্স কিংবা অন্য কোন অনুমোদন। স্থানীয় প্রভাবশালী ও জলদস্যুদের সহায়তায় এই ব্যবসা চালু রেখেছে বলেও অভিযোগ করেছেন কেউ কেউ।
রোববার ঢাকা থেকে হাতিয়া রুটের লঞ্চ এমভি টিপুতে করে নিয়ে আসা হয় প্রায় আড়াইশ ঝুড়ি ইলিশ। এসব ঝুড়িতে গড়ে ২ হাজার মণ মাছ রয়েছে বলে জানান এক বেপারী। একইদিন অন্যান্যভাবেও আরো দেড় হাজার মণ ইলিশ নেওয়া হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
তিনি জানান, বছরের সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ৪ মাস জালে ইলিশ বেশি আটকা পড়ে। ব্যবসায় লাভও করতে হয় এই চারমাসেই। এ সময় প্রতিদিন ৫ হাজার মণ ইলিশ ঢাকায় নেওয়া হয়। তবে বেশিরভাগ ইলিশই থাকে মাঝারি আকৃতির। সে অনুযায়ী গড়ে ইলিশের মণ ২৫ হাজার করে হলে প্রতিদিন ঢাকায় নেওয়া হয় সাড়ে ১২ কোটি টাকার ইলিশ। ঢাকার আড়ৎদার ছাড়া সরকারকে আর কেউ কোন ট্যাক্স দেয় না বলেও জনান এই বেপারী।
লাইসেন্স ছাড়া কোটি কোটি টাকার এই ব্যবসা প্রসঙ্গে মনপুরার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা অহিদুর রহমানের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, “কিছু ব্যবসায়ী লাইসেন্স ছাড়াই ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে আমরা তাদের সচেতন করে দিচ্ছি। আশা করছি, ভবিষ্যতে এমনটি আর থাকবে না।”
হাতিয়ার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাহিদুর রহমান বলেন, “অনুমোদনহীন ও সরকারের কর ফাঁকি দিয়ে ব্যবসা পরিচালনাকারী সনাক্ত হলে তাদের বিরুদ্ধে আইনত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
এদিকে যাত্রীবাহী লঞ্চ জুড়ে প্রতিদিন ইলিশ আনাকে যাত্রীদের জন্য চরম দুর্ভোগ বলেও অভিযোগ করেছেন অনেকে। শাহআলম নামে এক যাত্রী বলেন, “ইলিশ মাছ বহনের জন্য আলাদা লঞ্চ থাকা উচিত। যাত্রীবাহী লঞ্চে মাছ পারাপার করায় একদিকে মাছের গন্ধে যাত্রীদের যেমন কষ্ট হচ্ছে, অন্যদিকে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হচ্ছে গাদাগাদি করে।”
অন্যরা বলেন, “মাছ নেওয়ার জন্য হাতিয়া থেকে ছেড়ে আসার পর ভোলার আগ পর্যন্ত ঘাটে ঘাটে অনেক সময় লঞ্চ দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। এতে করে যাত্রীদের বাড়তি সময় নষ্ট হচ্ছে।”
তবে লঞ্চের মাস্টার এই অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, “আমরা যাত্রীদের বাড়তি সময় নষ্ট করছি না। কোন ঘাটে অতিরিক্ত দেরি করলেও নির্দিষ্ট সময়েই লঞ্চ ঢাকায় পৌঁছে যায়।”