ক্যামেলস রেটিংয়ে বি শ্রেণীভুক্ত প্রথম সারির একটি ব্যাংক হওয়া সত্ত্বেও আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংককে আর্লি ওয়ার্নিংয়ে রেখেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। অথচ ব্যাংকটির মোট আমানতের পরিমান ১১ হাজার ৫৬৯ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। পরিশোধিত মূলধন মাত্র এক বছরেই বেড়েছে ২১ শতাংশ। অনুমোদিত মূলধন দাঁড়িয়েছে এক হাজার কোটি টাকা। জাতীয় উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে ব্যাংকটির বিনিয়োগ ৯ হাজার ৮৪৭ কোটি টাকারও বেশি।
কেন ব্যাংকটিকে আর্লি ওয়ার্নিংয়ে রাখা হয়েছে এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, “যখন ব্যাংকটিকে আর্লি ওয়ার্নিংয়ের তালিকায় নেওয়া হয় তখন এটির অবস্থা খারাপ ছিলো। তবে এখন ব্যাংকটি ভালো করছে সে খবর আমাদের কাছে রয়েছে।”
এ প্রসঙ্গে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক একরামুল হক বলেন, এটি আমাদের হাতে নয়, আমাদের পক্ষ থেকে যা কিছু করার তার ষোলআনা আমরা করার চেষ্টা করেছি। ক্যামেলস রেটিংয়ে এখন দেশের অন্যতম একটি বেসরকারি ব্যাংক আল-আরাফাহ্। রেমিট্যান্স আনার ক্ষেত্রে ব্যাংকটির অবস্থান বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে চতূর্থ। খেলাপি ঋণের পরিমান দেশের যেকোনো ব্যাংকের চেয়ে কম।
একরামুল হক বলেন, ব্যাংকের ক্যাপিটাল, অ্যাসেট, ম্যানেজমেন্ট, আর্নিং, লিকুইডিটি ও সেনসিভিটি (ক্যামেলস) এই সবকটি মানদণ্ডেই আমরা এগিয়ে রয়েছি অনেক ব্যাংকের চেয়ে। আর্লি ওয়ানিংয়ে নেই এমন অনেক ব্যাংক আল-আরাফাহর থেকে পিছিয়ে রয়েছে।
তিনি বলেন, ২০০৫ সালে ব্যাংকটির অপেক্ষাকৃত খারাপ অবস্থার কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এটিকে আর্লি ওয়ার্নিংয়ের ক্যাটেগরিতে নেয়। কিন্তু সে অবস্থার পর থেকেই সার্বিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে উত্তরোত্তর উন্নতি করে যাচ্ছে আল-আরাফাহ। বছরে বছরে উন্নতি করে ২০১০ সালে আল-আরাফা ব্যাংক তার মুনাফা, আমানত, বিনিয়োগ, আমদানি বাণিজ্য, রপ্তানি বাণিজ্য, ব্যাংক শাখাসহ সকল ক্ষেত্রেই আদর্শ অবস্থার চেয়েও অনেক বেশি উন্নতি নিশ্চিত করে। এরপর দুই বছর কেটে গেলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক আল-আরাফাহকে আর্লি ওয়ার্নিংয়ের কোটামুক্ত করেনি।
২০০৫ সালে ব্যাংকটি আর্লি ওয়ার্নিংয়ে নেওয়ার সময় থেকে ২০১২ সালের সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত ব্যাংকের সার্বিক অগ্রগতির একটি তুলনামূলক চিত্রও তুলে ধরেন একরামুল হক। তিনি জানান ২০০৫ সালে অথরাইজড ক্যাপিটাল ছিলো ১০০ কোটি টাকা যা বর্তমানে ১০০০ কোটি টাকায় দাঁড়িয়ছে। পেইড আপ ক্যাপিটাল ৬৭ কোটি ৭৯ লাখ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৭১৩ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। ক্যাপিটাল এডিকোয়েসি রেশিও ১০.৭ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ১২.৫২ শতাংশ। বিনিয়োগ ২০০৫ সালে ৮৫২ কোটি টাকা ছিলো যা বর্তমানে ৯৮৪৭ কোটি টাকা। আমানত ২০০৫ সালে ছিলো ১ হাজার ৩২ কোটি টাকা যা ২০১২ সালের সেপ্টেম্বরে দাঁড়িয়েছে ১১ হাজার ৫৫৯ কোটি টাকা।
শ্রেণীভুক্ত বিনিয়োগের ওপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ আনতে পেরেছে আল-আরাফাহ একথা বলে একরামুল হক জানান, ২০০৫ সালে এই বিনিয়োগের পরিমান ছিলো ৮.৭৭ শতাংশ যা ২০১১ সাল শেষে .৯৫ শতাংশে নামিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে।
তিনি আরও জানান, এই সময়ের ব্যবধানে আমদানি বাণিজ্য ৫০০% বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০০৫ সালে যা ছিলো ৫০৮ কোটি টাকা তা ২০১২ সালের সেপ্টেম্বরের হিসাবে ৫ হাজার ৫শ’ ৯৯ কোটি টাকা। রপ্তানি বাণিজ্য ১৯৩.৮৭ কোটি টাকা থেকে ৪ হাজার ৬৪৮.৭ কোটি টাকা। ব্যাংকটির মাধ্যমে ২০০৫ সালে রেমিট্যান্স এসেছে ১৬ কোটি ৫৪ লাখ টাকা যা গত সেপ্টেম্বরে ছিলো ১৫৩২ কোটি ৪২ লাখ টাকা। মুনাফা ২০০৫ সালের ১৮ কোটি ৩৪ লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২০১১ সালে ৪১০ কোটি টাকায় উন্নিত করা হয়েছে।
একরামুল হক আরও জানান, ২০০৫ সালে ব্যাংকটির শাখা ছিলো ৪০টি যার সংখ্যা বর্তমানে ৯৮টি। তিনি বলেন, কেবল গত এক বছরেই নতুন শাখা খোলা হয়েছে ১৭টি।
এমনকি খেলাপি ঋণের ক্ষেত্রেও আল-আরাফাহ তার অবস্থান সবচেয়ে ভালো। ডিসেম্বর ২০১১ এর একটি হিসাবে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ মাত্র .৯৫ শতাংশ। যা দেশের ব্যাংকগুলোর মধ্যে সর্বনিম্ন।
একরামুল বলেন, এসব উন্নতির কারণে আল-আরাফা ব্যাংক এখন দেশের প্রথম সারির একটি ব্যাংক সে কথা আমরা দাবির সঙ্গে বলতে পারি।
এরপরেও বাংলাদেশ ব্যাংক কেনো তাদের আর্লিং ওয়ার্নিং থেকে সরিয়ে নিচ্ছে না জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিদ্ধান্তের বিষয়। আমরা আমাদের করণীয় কাজগুলোই করে যাচ্ছি।
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের একটি সূত্র জানায়, আর্লি ওয়ার্নিং থেকে বের হওয়ার জন্য আল-আরাফাহর পক্ষ থেকে দুই দফা চিঠি পাঠানো হয়েছে কিন্তু তাদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে বিলম্ব হচ্ছে। সূত্রটি জানায় ২০১১ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর আল-আরাফাহ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান বদিউর রহমান বাংলাদেশ ব্যাংকের অফ-সাইট সুপারভিশন বিভাগের মহাব্যবস্থাপক বরাবর একটি চিঠি পাঠান। এতে তিনি ব্যাংকটিকে আর্লি ওয়ার্নিংয়ের আওতা থেকে অব্যাহতি চান। চিঠিতে ব্যাংকটির আর্থিক সূচকসহ ব্যাংকিং ক্ষেত্রে অর্জিত উল্লেখযোগ্য অগ্রগতির বিষয়গুলো বিবেচনা করার অনুরোধ জানানো হয়। পরে ২০১২ সালের ২৪ জানুয়ারি ব্যবস্থাপনা পরিচালক একরামুল হক আরো একটি চিঠি পাঠান বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমানের কাছে। এই চিঠির কপি যায় অফ-সাইট সুপারভিশন বিভাগের ডেপুটি গভর্নর এবং মহাব্যবস্থাপকের কাছেও।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে একরামুল হক বলেন, আমরা দুই দফা চিঠি পাঠিয়েছি। দ্বিতীয় চিঠির পর প্রায় ৯ মাস কেটে গেলেও বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।
একরামুল বলেন, আল-আরাফার লাখ লাখ সঞ্চয়কারীর নিরাপদ ও নিরুদ্বেগ ব্যাংকিংয়ের জন্য এ অবস্থা থেকে পরিত্রান জরুরি।
এ প্রসঙ্গে অফ-সাইট সুপারভিশন বিভাগের একজন কর্মকর্তা বলেন, আমরা দেখেছি আল-আরাফাহ ভালো করছে। সংবাদমাধ্যমেও বিষয়টি আসছে। আরও কিছুদিন অবজারভেশনে রেখে এ বিষয়ে হয়তো সিদ্ধান্ত নেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
নাম প্রকাশ না করে ওই কর্মকর্তা জানান, আল-আরাফাহর কয়েকটি শাখার অনিয়ম কেন্দ্রীয় ব্যাংকে রিপোর্ট করার পরেই তাদের বিরুদ্ধে আর্লি ওয়ার্নিংয়ের ব্যবস্থা নেওয়া হয়।“
তিনি বলেন, ব্যাংকটির ভালো করার বিষয়গুলো সংবাদ মাধ্যমেও আসছে। এগুলো নিয়ে ফের আবেদন করা হলে তা নিশ্চয়ই কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিবেচনা করবে।