মিয়ানমারে দাঙ্গা পাঁচদিনের পুশব্যাক দেড় বছরের রেকর্ড ছাড়াল

মিয়ানমারে দাঙ্গা পাঁচদিনের পুশব্যাক দেড় বছরের রেকর্ড ছাড়াল

মিয়ানমারে আরাকান রাজ্যের মংডু এলাকায় জাতিগত সংঘাত শুরুর পর থেকে রেকর্ড সংখ্যক পুশব্যাকের ঘটনা ঘটেছে। শুধু গত পাঁচদিনে অনুপ্রবেশের চেষ্টাকারী ৬৫৪ জন রোহিঙ্গা নাগরিককে মায়ানমারে ফেরত পাঠিয়েছে বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবি।

জানা গেছে, মাত্র পাঁচদিনে পুশব্যাকের এই সংখ্যা মাসের হিসেবে গত দেড় বছরের রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে।

তবে বিজিবি দাবি করেছে, মিয়ানমারের পরিস্থিতি উন্নতি হতে শুরু করায় আজ (বৃহস্পতিবার) থেকে অনুপ্রবেশের চেষ্টাকারীর সংখ্যাও কমে এসেছে। কিন্তু টেকনাফে থাকা রোহিঙ্গা শরণার্থীরা এবং এদেশীয় দালাল চক্র মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশের জন্য উৎসাহিত করায় টেকনাফে এখনও কিছুটা অস্থিতিশীলতা বিরাজ করছে।

অভিযোগে জানা গেছে, টেকনাফে সক্রিয় বেশ কয়েকটি এনজিও সংস্থাও রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশে উৎসাহিত করছে, মদদ দিচ্ছে।

টেকনাফে বিজিবি’র ৪২ ব্যাটেলিয়নের অধিনায়ক লে.কর্নেল জাহিদ হাসান বলেন, ‘আমরা বিভিন্ন সোর্সে খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছি, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করতে শুরু করায় সেখানে পরিস্থিতি প্রায় স্বাভাবিক হয়েছে। এজন্য অনুপ্রবেশের চেষ্টাও কমেছে। তবে এখনও যে ক’জন অনুপ্রবেশের চেষ্টা করছেন তারা এদেশের রোহিঙ্গাদের মাধ্যমে বিভ্রান্ত হয়ে এবং মিয়ানমারের পরিস্থিতি না জেনে করছেন।’

বিজিবি সূত্রে জানা গেছে, চলতি জুন মাসের ১৩ তারিখ পর্যন্ত মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টাকারী ৭২০ জনকে ধরে সেদেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে। এরমধ্যে গত পাঁচদিনে (বৃহস্পতিবার পর্যন্ত) ১৪টি ট্রলারে ফেরত গেছে ৬৫৪ জন।

এছাড়া বৃহস্পতিবার সকালে টেকনাফের গোলারচর এলাকায় ট্রলার থেকে নেমে কেওড়া বনে লুকিয়ে থাকা ৭ জনকে আটক করে বিজিবি। এসময় সেখান থেকে তাদের অনুপ্রবেশে সহযোগিতাকারী ৪ জন এদেশীয় আদম পাচারকারীকেও আটক করেছে বিজিবি।

পরে আটক ৭ জন রোহিঙ্গাকে সেন্টমার্টিনে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে আগে থেকে আটকে থাকা ৪৪ জন মিয়ানমার নাগরিকের সঙ্গে তাদের রাখা হয়েছে। তাদের সবাইকে একসঙ্গে পুশব্যাক করা হবে বলে জানিয়েছেন বিজিবি’র ৪২ ব্যাটেলিয়নের অপারেশন অফিসার ক্যাপ্টেন এইচ কামরুল হাসান।

বিজিবি সূত্র জানায়, গত ১০ জুন থেকে ১৪ জুন পর্যন্ত পাঁচদিনে যত পুশব্যাক হয়েছে ২০১১ সাল থেকে গত দেড় বছরেও তা হয়নি।

বাংলাদেশ-মিয়অনমার সীমান্ত পথে ২০১১ সালে বাংলাদেশ থেকে মিয়ানমারে পুশব্যাক করা হয়েছে ১ হাজার ৭৮৯ জনকে। এর মধ্যে জানুয়ারিতে ৬৪ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৭৬ জন, মার্চে ৮৩ জন, এপ্রিলে ১৩২ জন, মে তে ২৫৫ জন, জুন মাসে ১৩১ জন, জুলাইতে ৭৩ জন, আগস্টে ১২৮ জন, সেপ্টেম্বরে ১৬১ জন, অক্টোবরে ১০০ জন, নভেম্বরে ২৮৩ জন এবং ডিসেম্বরে ৩০৫ জনকে পুশব্যাক করা হয়েছে।

২০১২ সালের জানুয়ারিতে ২১৪ জনকে, ফেব্রুয়ারিতে ৪৪৫ জনকে, মার্চে ২৭৫ জনকে, এপ্রিলে ১৮৮ জনকে, মে মাসে ১৩২ জন এবং জুন মাসের গত ১৩ দিনে ৭২৩ জনকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হয়েছে।

বিজিবি সূত্র জানিয়েছে, বুধবার থেকে গত দু’দিনে যাদের আটক করা হয়েছে তাদের মধ্যে নতুনভাবে এসেছে এমন কেউ নেই। তাদের অনেককে আগেও পুশব্যাক করা হয়েছিল।

সূত্র আরও জানায়, নাফ নদী দিয়ে ২৪টি পয়েন্টে অনুপ্রবেশকারীদের ঢোকা সম্ভব। এর মধ্যে নাজিরপাড়াসহ ৬-৭টি পয়েন্ট আছে যেগুলো দিয়ে বেশিরভাগ রোহিঙ্গারা প্রবেশের চেষ্টা করেন। তবে এসব পয়েন্ট সিল করে দেয়া হয়েছে বলে সূত্র জানায়।

বিজিবি’র ৪২ ব্যাটেলিয়নের অধিনায়ক জানান, অনুপ্রবেশ ঠেকাতে নাফ নদীপথে বিজিবি’র নজরদারি আরও জোরদার করা হয়েছে। ৯টি জলযান রাতভর নাফ নদীতে টহল দিচ্ছে। এছাড়াও গ্রামে গ্রামে রোহিঙ্গা লুকিয়ে আছে কিনা সেটা জানতেও সোর্স নিয়োগ করা হয়েছে।

বিজিবি সূত্র জানায়, নাফ নদীর উপকূলে মায়ানমার এলাকায় ৫৪ কিলোমিটারের মধ্যে ৪৮ কিলোমিটারে কাঁটাতারের বেড়া আছে। বিজিবি কর্মকর্তারা খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছেন, এসব কাঁটাতারের চেকপোস্ট পার হয়ে নাফ নদীতে নামার ক্ষেত্রে নাসাকা বাহিনীও এখন রোহিঙ্গাদের বাধা দিচ্ছে। এর ফলে অনুপ্রবেশের চেষ্টকারীর সংখ্যা আস্তে আস্তে কমে আসছে।

বিজিবি সূত্র জানায়, টেকনাফে নয়াপাড়া এবং লেদাটাং সহ বিভিন্ন এলাকার শরণার্থী রোহিঙ্গারা মোবাইল ফোনের মাধ্যমে সেদেশের রোহিঙ্গাদের এদেশে চলে আসার জন্য মদদ দিচ্ছে। টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ এলাকার কিছু সাধারণ মানুষ এবং দালাল চক্রও তাদের আশ্রয় দেয়ার কথা বলে এদেশে আসার জন্য উৎসাহিত করছেন। এছাড়া কয়েকটি এনজিও বিভিন্ন গ্রামে গিয়ে মানুষকে রোহিঙ্গাদের এদেশে ঢুকতে দেবার জন্য চাপ সৃষ্টি করতে উস্কানি দিচ্ছেন বলে সূত্র জানিয়েছে।

বিজিবি’র ৪২ ব্যাটালিয়ন অধিনায়ক লে. কর্নেল জাহিদ হাসান বলেন, “কিছু এনজিও যারা রোহিঙ্গাদের নিয়ে কাজ করে, তারা পর্দার আড়ালে থেকে উস্কানি দিচ্ছে বলে বিভিন্নভাবে শুনতে পেয়েছি। তবে এ ধরনের কোনো গোয়েন্দা প্রতিবেদন কিংবা নিশ্চিত তথ্য আমাদের কাছে নেই।”

এদিকে টেকনাফের ঘোলারচর থেকে বৃহস্পতিবার যে ৪ জন আদম পাচারকারীকে আটক করা হয়েছিল তারা রোহিঙ্গাদের টেকনাফে প্রবেশের বিষয়ে সহযোগিতা করছিল বলে বিজিবি’র কাছে স্বীকার করেছে।

বিজিবি’র ৪২ ব্যাটালিয়ন অপারেশন অফিসার ক্যাপ্টেন এইচ কামরুল হাসান জানান, আটক হওয়া ৪জন সহ মোট ৭জনকে টেকনাফে ঢোকানোর কথা বলে টাকা নিয়েছিল দালালরা। পরে তারা সাতজনকে বহনকারী ট্রলারটিতে লুটপাট চালিয়ে সেটিকে ঘোলারচরের কেওড়া বনে নিয়ে তাদের নামিয়ে দেয়।

লে. কর্ণেল জাহিদ হোসেন বলেন, “বিচ্ছিন্নভাবে কেউ কেউ দালালদের মাধ্যমে অথবা নিজে ঝুঁকি মাথায় নিয়ে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করছেন। তবে সেটার সংখ্যা খুব বেশি নয়। আমাদের নজরদারি এড়িয়ে ঢোকাও সম্ভব নয়।”

বাংলাদেশ