আমার লেখার শিরোনামটি ১৯৭১ সালের প্রকাশিত পত্রিকা ‘দৈনিক সংগ্রাম’ পত্রিকা থেকে নেওয়া। সে সময় পত্রিকাটির কোনো মূল্য স্বাধীনতাকামী মানুষের কাছে ছিল না। রাজাকার আল বদরদের পত্রিকাটি দাপট দেখিয়েছে যুদ্ধের পুরোটা সময়।
তবে আজ এ পত্রিকাটিই রাজাকারদের থলের বেড়াল বের করতে সাহায্য করছে।
এবার শিরোনামে আসি। একাত্তরের ১২ জুলাই দৈনিক সংগ্রামের ‘তুমি মহারাজ সাধু হলে আজ’ শিরোনামে সম্পাদকীয়তে একটি লেখা প্রকাশ পায়। ভারত এবং বাংলাদেশের মুক্তির স্বপ্নের বিরুদ্ধে লেখাটির এক পর্যায়ে উল্লেখ ছিল,
‘…যারা পূর্ব পাকিস্তানি মানুষের সর্বনাশকারী দালাল নেতাদের গালভরা বুলিতে বিভ্রান্ত হয়ে হাওয়াই বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখে, হিন্দুস্তানের মাটিতে বসে যে সব তথাকথিত নেতা ‘বাংলাদেশ’ আন্দোলন করছেন, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত না হলে যে অবিভক্ত ভারতে তাদের অস্তিত্বই থাকতো না, একথা বোঝার জ্ঞানটুকুও তাদের থাকা উচিত।’
যাই হোক। গত দু’দিন ধরে মিডিয়ার নজর চলে গেছে গোলাম আযমের দিকে। তার নামের আগে ‘অধ্যাপক’ যুক্ত করা হচ্ছে। আমি যদিও জানি না, মানুষ হত্যায় জড়িত এবং দেশবিরোধী থেকেও তার নামের পাশে অধ্যাপক নামটিও কী করে থেকে যাচ্ছে!
গোলাম আযমের নামে অভিযোগের অন্ত নেই। একাত্তরে পাকিস্তান রক্ষায় যার চেষ্টার অন্ত ছিলো না, তাকে নিয়ে হুট করে মিডিয়ার আগ্রহ নিয়ে আজ বস্ত্র ও পাটমন্ত্রীও আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী বিষ্ময় প্রকাশ করেছেন।
তবে নতুন প্রজন্মের কাছে এতে বিষ্মিত হওয়ার কিছু নেই; বরং সবাই তো আগ্রহ নিয়েই দেখছেন। আগ্রহ নিয়ে তার বক্তব্য শুনছেন। পাঞ্জাবি-টুপি পরে কী অবলীলায় মিথ্যা বলে যাচ্ছেন গোলাম আযম সেটাই দেখার সৌভাগ্য হচ্ছে সকলের!
মিডিয়ার কাছে সকল অভিযোগ অস্বীকার করছেন গোলাম আযম। তার বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ। বার বার জোর দিয়ে বলছেন, কোনো প্রমাণই তার বিরুদ্ধে দাঁড় করানো যাবে না।
ঠিক তখনই দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকাটির কিছু অংশবিশেষ নিয়ে লেখার আগ্রহবোধ করি।
১৯৭১ সালের ২১ জুন ‘পাকিস্তানের আদর্শের প্রতি অবজ্ঞাই পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনাবলীর কারণ’ শিরোনামে দৈনিক সংগ্রাম লাহোরে গোলাম আযমের সাংবাদিক সম্মেলনের বক্তব্য গুরুত্ব দিয়ে প্রথম পাতায় প্রকাশ করে। এ সম্মেলনের এক পর্যায়ে গোলাম আযম বলেন,
‘সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে প্রায় সকল দুস্কৃতিকারীদের উৎখাত করেছে এবং বর্তমানে এমন কোনো শক্তি নেই যা সেনাবাহিনীর প্রাধান্যকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে।’
অন্যদিকে ২২ জুন পত্রিকাটি গোলাম আযমের বড় ছবিসহ একটি সাক্ষাৎকার বক্স করে প্রকাশ করে। সাক্ষাৎকারে গোলাম আযম বলেন,
‘পূর্ব পাকিস্তানের মুসলমানরা ইসলামকে কখনো পরিত্যাগ করতে পারবে না। এ কারণে তারা পাকিস্তানকেও ত্যাগ করতে পারবে না। পূর্ব পাকিস্তান, ইসলাম ও পাকিস্তানের জন্য অপরিসীম ত্যাগ স্বীকার করেছে। আরো কোরবানি দেয়ার জন্য তারা প্রস্তুত আছে।’
বর্তমান সময়ে মিডিয়াতে গোলাম আযম বলতে চাচ্ছেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি এমন কিছুই করেননি, যা মানবতা বিরোধী কিংবা দেশ বিরোধী।
তবে এর উত্তরও পাওয়া যায় একাত্তরের দৈনিক সংগ্রামে ১২ আগস্ট প্রকাশিত সংবাদে। শিরোনাম ছিল ‘তথাকথিত বাংলাদেশ আন্দোলনের সমর্থকরা ইসলাম, পাকিস্তান ও মুসলমানের দুশমন।’ সেখানে তিনি বলেন,
‘ইসলাম, পাকিস্তান ও মুসলমানদের দুশমন তথাকথিত বাংলাদেশ আন্দোলনের সমর্থকরা আর যাই হোক দেশের ভালো ভালো সৎ লোক, ইমানদার লোক, পাকিস্তানের প্রতি অনুগত ও আস্থাভাজন লোকদের বহু সংখ্যককে ইতিমধ্যে শহীদ করেই ছাড়েনি তারা মওলানা মাদানী সাহেবের মতো একজন সর্বজন শ্রদ্ধেয় আলেম, বুজর্গ পীর এবং মোখলেছ পাকিস্তানিকেও শহীদ করতে সাহসী হয়েছে যার সমগ্র জীবন ইসলাম ও পাকিস্তানের জন্য ওয়াকফ। তার শাহাদাত গোটা পাকিস্তানের মুসলিম মানস চরমভাবে বিক্ষুদ্ধ। তথাকথিত বাংলাদেশ আন্দোলনের সমর্থকদের উচিত, তাদের ঈমানকে দূরস্ত করা। মওলানা মাদানীর এ শাহাদাতের এলাকার দুস্কৃতিকারীদের তন্ন তন্ন করে তালাশ করে তাদের থেকে দেশকে মুক্ত করার জন্য রাতদিন চেষ্টা করবে। ….’
এসব বক্তব্যই গোলাম আযমকে পাকিস্তানের উৎকৃষ্ট ‘গোলাম’ হিসেবেই প্রমাণ করে। তিনি বাংলাদেশকে চাননি, বাংলাদেশের স্বাধীনতা চাননি সেটাই তো প্রমাণিত হয় এসব বক্তব্যে ।
একাত্তরের মানব হত্যার কথা না হয় ভুলে গেছেন; কারণ, বয়স হয়েছে! তবে পাকিস্তানের প্রতি ভালোবাসার কথা তো ভোলার কথা না। পাকিস্তানের প্রতি অগাধ প্রেম তিনি ভুলে গেলেন কী করে?
বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র তো তার কাছে ‘তথাকথিত রাষ্ট্র’। এ তথাকথিত রাষ্ট্র আর একদিন পরই পালন করবে স্বাধীনতার চল্লিশ বছর। স্বাধীনতার চল্লিশ বছর পর মহারাজ সাধু হয়ে বলছেন, কোনো প্রমাণ দাঁড় করানো যাবে না!