প্রতিবছর বাজেট প্রণয়নের প্রাক্কালে বাজেটে ‘কালো টাকা’ ‘সাদা’ করার সুযোগ দেওয়া হবে কি না- এ নিয়ে ব্যবসায়ী ও সুশীল সমাজের মধ্যে এক ধরনের বাহাস লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কিন্তু বাহাসটা আসলে হওয়া উচিত কালো টাকার উৎস কীভাবে বন্ধ করা যায়, সেটা নিয়ে। বিষয়টি নিয়ে যে কেউ প্রশ্ন তোলেন না, তা নয়। তবে সেটা অতটা জোরালো নয়। ভাবখানা যেন বাজেটে কালো টাকা ‘সাদা’ করার সুযোগ না দিলেই সব দায় চুকে গেল।
সম্প্রতি কালো টাকার উৎস বন্ধ করা সম্পর্কে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের কাছে সাংবাদিকরা জানতে চাইলে তিনি বলেন, “দেশ থেকে কালো টাকা উচ্ছেদ খুব সহজ কাজ নয় এবং তা সম্ভবও হবে না। দুনিয়ার সব কালচারে আছে, এমনকি মার্কিন মুল্লকেও রয়েছে।“
এ প্রসঙ্গে তিনি প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সকে একটি প্রধান কারণ হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, “তাদের পাঠানো অর্থের উৎস সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন তোলা হয় না। এছাড়া ট্যাক্স যেখানে আছে, সেখানে ট্যাক্স ফাঁকিও আছে।“
অর্থমন্ত্রীর এ বক্তব্য আংশিক সত্য। কালো টাকার উৎস বলতে তিনি শুধু বাইরের উৎসের কথা বলেছেন। কিন্তু প্রতিনিয়তই দেশের অভ্যন্তরে অবৈধভাবে (যেমন কালোবাজারি, চোরাচালান, ঘুষ-দুর্নীতি ইত্যাদি) যে কালো টাকার উৎপত্তি হচ্ছে, সে সম্পর্কে তিনি কিছু বলেননি।
বাজেটে কালো টাকা ‘সাদা’ করার সুযোগ প্রদান সম্পর্কে তিনি বলেছেন, “কালো টাকা আমি পছন্দ করি না। আমি এটা চাইও না। কিন্তু দেশের স্বার্থে বা কোনো গুরুত্বপূর্ণ খাতের স্বার্থে সেই রকম উদ্যোগ নিতে হয়।“
সুতরাং এবারের বাজেটে কালো টাকা ‘সাদা’ করার সুযোগ দেওয়া হবে কি না-এ ব্যাপারে তিনি নিশ্চিত করে কিছু না বললেও এটা অনুমান করে নেওয়া যায় যে, এবারও এ সুযোগ থাকছে।
অন্যদিকে সরকার কালো টাকা ‘সাদা’ করার সুযোগ দিলেও সেটা ‘অচ্ছুৎ নয়’ এমন একটা ধারণা জনমনে তৈরির চেষ্টা চালাচ্ছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। গত কয়েক বছর ধরেই এ চেষ্টা চলছে।
এনবিআর-এর মতে, এটা আসলে ঠিক ‘কালো’ টাকা নয়, ‘অপ্রদর্শিত আয়’ বলা যেতে পারে। আর ‘অপ্রদর্শিত আয়’ বলতে করের আওতায় আনা হয়নি কিন্তু বৈধভাবে অর্জন করা হয়েছে, এমন অর্থের কথাই বলা হচ্ছে। অবৈধভাবে (যেমন কালোবাজারি, চোরাচালান, ঘুষ-দুর্নীতি ইত্যাদি) অর্জিত আয় এর আওতায় পড়বে না।
প্রসঙ্গত: চলতি অর্থবছরের বাজেটে ১০ শতাংশ হারে কর দিয়ে শেয়ারবাজারে বিনা প্রশ্নে অপ্রদর্শিত আয় বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এই সুযোগ নিয়ে যারা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করবেন, তাদের আয়ের উৎস সম্পর্কে সরকারের অন্যান্য সংস্থাগুলো বিশেষত ‘দুর্নীতি দমন কমিশন’ (দুদক) প্রশ্ন তুলতে পারে।
এ বিষয়ে গত ডিসেম্বরের শেষ দিকে এক সংবাদ সম্মেলনে এনবিআর জানায়, “আগামী জুন পর্যন্ত ১০ শতাংশ হারে কর দিয়ে শেয়ারবাজারে কালোটাকা বিনিয়োগ করে তা বৈধ করা যাবে। কিন্তু অন্য আইনে কী আছে বা প্রশ্ন করা হবে কি না, তা দেখার বিষয় এনবিআর-এর নয়।“
এখানে আরো একটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, যতবারই কালো টাকা ‘সাদা’ করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে, ততবারই সৎ করদাতাদের অনুভূতির বিষয়টি উপেক্ষা করা হয়েছে। প্রতিবারই দেখা গেছে, একজন সৎ করদাতা যে হারে আয়কর দিয়ে থাকেন, এর চেয়ে অনেক কম টাকা কর দিয়ে কালো টাকা ‘সাদা’ করে নিচ্ছেন সুযোগ সন্ধানীরা।
স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি সরকারের আমলেই কালো টাকা সাদা করা হয়েছে। এর মধ্যে সর্বপ্রথম জিয়া সরকারের আমলে ৭০ কোটি টাকা, এরশাদ সরকারের আমলে ৪৫০ কোটি টাকা, বিএনপি নেতৃত্বাধীন চার দলীয় জোট সরকারের আমলে ৬ হাজার ৩ কোটি টাকা এবং গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ৯ হাজার ৬৭৭ কোটি কালো টাকা সাদা করা হয়েছে।
বর্তমান মহাজোট সরকারের আমলের প্রথম অর্থবছরে (২০০৯-১০) ৯২২ কোটি ৯৮ লাখ কালো টাকা সাদা করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
উল্লেখ্য, ১৯৯১ সালের বিএনপি সরকার ও ২০০১ সালের আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে কালো টাকা সাদা করার কোনো সুযোগ দেওয়া হয়নি।
এক সময় ব্যাংকিং খাতে কালো টাকা জমা রাখার জন্য ‘বিয়ারা সার্টিফিকেট অব ডিপোজিট’ (বিসিডি) নামে এক ধরনের সঞ্চয়ী হিসাব চালু ছিল। এই অ্যাকাউন্টে টাকা রাখতে আমানতকারীদের নাম-ঠিকানার কোনো প্রয়োজন হতো না। কেবল একটি নম্বরের মাধ্যমে টাকা জমা রাখা এবং মুনাফাসহ আসল টাকা তোলা যেতো। কিন্তু ২০০২ সালে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন কার্যকর হওয়ার পর থেকে ব্যাংকিং খাতে কালো টাকা রাখার আর কোনো সুযোগ নেই। কারণ এখন ব্যাংকে কোনো অ্যাকাউন্ট খুলতে গেলে বা টাকা জমা রাখতে গেলে টাকার উৎস সম্পর্কে ব্যাংককে অবহিত করতে হয়।